ওষুধ শিল্প : শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেছে আমাদের ওষুধ শিল্পে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্ব ছাড় ১৭ বছর বাড়ল। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পখাত ২০৩৩ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব ছাড় পাওয়ার ফলে নতুন আশাবাদে প্রাণ ফিরে পেয়ে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের রফতানির দরজা অবারিত হলো। এখন বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে বিশ্বমানের ওষুধ শীর্ষস্থানীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের হৃদরোগ প্রতিরোধী কার্ভিডিলোল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের অনুমোদন পাওয়ায় ওষুধ শিল্পের নতুন অভিযাত্রা শুরু হলো। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর চাহিদার শতকরা ৭০ ভাগ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। এখন উন্নত প্রযুক্তির সব কারখানায় ওষুধ উৎপাদিত হওয়ার রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। বিশ্ববাজারের তুলনায় কম দাম, উৎপাদন, গুণগত মান, উচ্চমানের ওষুধ প্রস্তুতকরণ, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের ক্ষেত্রে এ শিল্প নিজেদের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করার পাশাপাশি বিশ্বের ১৬০টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে আমাদের ওষুধ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে জানা গেছে, দেশীয় ৪৬ কোম্পানির প্রায় ৩০০ আইটেমের ওষুধ যাচ্ছে বিদেশে। ২০১১-১২ অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছিল চার কোটি ৮২ লাখ ডলার। গত (২০১৫-১৬) অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট কোটি ২১ লাখ ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা প্রায় সাড়ে ৬৫০ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ছয় কোটি ডলারের, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রায় সাত কোটি ডলারের ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত কোটি ২৬ লাখ ডলারের ওষুধ রফতানি করেছে বাংলাদেশ। ওষুধ শিল্পের এমন অগ্রগতির ফলে গত পাঁচ বছরে রফতানি আয় দ্বিগুণ হয়েছে। আশার খবর হচ্ছে- রফতানি আয়ে বাংলাদেশ এখন শুধু পোশাক শিল্পের ওপরই নির্ভরশীল নয়, ওষুধ শিল্প পরিপূরক হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। এবার শুধু ওষুধ রফতানির মাধ্যমেই বিশ্ববাজার থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আয় হবে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, ১৯৯২ সালে ইরান, হংকং, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পেনিসিলিন তৈরির কাঁচামাল রফতানি করে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। পরবর্তী বছরে প্যারাসিটামল গ্রুপের নাপাসহ ১৮ আইটেমের ওষুধ রাশিয়ার বাজারে রফতানি করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকে প্রতিবছরই রফতানির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে- বাংলাদেশের নতুন নতুন কোম্পানির ওষুধ।
ওষুধ শিল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা গেছে, স্বাধীনতার আগে এখানকার ওষুধ শিল্পগুলো স্থানীয় পর্যায়ের মাত্র ২০ শতাংশ চাহিদা মেটাত। বাকি ৮০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হতো। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ওষুধের তীব্র সঙ্কটে পড়লে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রিতে অনীহা দেখায়। দুঃসময়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় হাঙ্গেরি নামক দেশটি। পূর্ব ইউরোপের এ দেশটির ইগিস, গেইডেন রিখটার, কাইরন, মেডিম্পেক্স কোম্পানি তখন বার্টার ট্রেডে বাংলাদেশে ওষুধ পাঠাতে রাজি হয়। বিনিময়ে বাংলাদেশ পাঠাত পাট ও অন্যান্য কাঁচা পণ্য। ১৯৮২ সালে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি হয়। এর ফলে বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাণিজ্য থেকে দেশীয় শিল্প মুক্তি পায়। এতসব বাধার পাহাড় পেরিয়ে আজকের ওষুধ শিল্পের গল্পটি ভিন্ন বিশ্বের অনুন্নত ৪৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে সবচেয়ে এগিয়ে। বর্তমানে এখানকার ২৫৭টি কোম্পানির কারখানায় বছরে ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল উৎপাদিত হচ্ছে। এই শিল্প প্রায় দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে ওষুধের জন্য এখন বার্ষিক ব্যয় ৯৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৪টি ওষুধ কারখানা সচল রয়েছে। এসব কোম্পানি সম্মিলিতভাবে প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারের বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে সর্বমোট ২৬৯টি এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্ততকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বছরে ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ১২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করছে। ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের সুফলের কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ওষুধের বাজার বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ওষুধ আমদানি করবে শ্রীলঙ্কা। ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ থেকে ৫২৫ ধরনের ওষুধ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, ইতালি, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, বর্তমানে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, সুইজারল্যান্ডসহ ১৬০টি দেশে রফতানি হচ্ছে।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওষুধ এবং ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদিত হয়। কুমিল্লা জেলার মেঘনা ঘাটের ডান দিকে বাউশিয়ায় ২০০ একর জায়গাজুড়ে বাংলাদেশে স্থাপিত হচ্ছে ওষুধের কাঁচামাল (এ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট-এপিআই) উৎপাদন কারখানা। ফলে বছরে এ দেশের সাশ্রয় হবে ১ হাজার কোটি টাকা। ক্যান্সারের দুর্লভ ও ব্যয়বহুল ওষুধ এখন দেশেই তৈরি হয়। ক্যান্সার ওষুধের বাজার বেশ বড়। সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে ওষুধ নিয়ে যেতে পারলে এই বাজার হয়ত ১০০ কোটি টাকার বা তারও বেশি হতে পারে।
এ শিল্প সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা- মাত্র আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের পরই ওষুধ রফতানি থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে। এই প্রত্যাশা নিয়ে এখন কেবলই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা আর বিশ্ববাজারের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ওষুধ রফতানিতে এশিয়ার শীর্ষে উঠে আসবে বাংলাদেশ। জানা গেছে, বিদেশে রফতানির পাশাপাশি দেশের বাজারে এখন বছরে ১৬ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়। আগামী ১০ বছরের মধ্যে এ দেশের ওষুধ খাতের রফতানি বাজার হবে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের উন্নীত করারও অসম্ভব কিছু নয় বলে শিল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। বর্তমানে ক্যান্সারের মতো রোগের কিছু ওষুধ ছাড়া অন্য কোন ওষুধ খুব বেশি আমদানি করতে হয় না বলে জানা গেছে।