নকশি পাখায় জীবন বদল
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
হাতপাখা, এটি শুধু ঘাম আর গরম থেকে আত্মরক্ষার উপকরণই নয়। চিরায়ত গ্রাম বাংলার কুটির শিল্পের অন্যতম অংশও বটে। হাতপাখা তৈরি ও বিক্রি করে এদেশের গ্রাম অঞ্চলের এক শ্রেণির নিম্ন আয়ের মানুষ এখনো জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। এমনই এক অঞ্চল গফরগাঁও উপজেলার বলদী গ্রাম। গুটিকয়েক পরিবার ছাড়া আর্থ সামাজিক অবস্থায় পিছিয়ে থাকা বদলী গ্রামের পুরোছবি এখন হাতপাখার বদৌলতে বদলে গেছে। যে গ্রামের শিশুদের অদৃষ্টে ছিল মজুরী, তারা এখন লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে হাতপাখার তৈরির কাজে লেগে যায়। সুঁইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে গড়ে তুলে আগামীর এক একটি স্বপ্ন। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার অভাবগ্রস্ত এ মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে এখন সোনালী স্বপ্নে বিভোর তাদের যাপিত জীবন। এর প্রধান কারণ তাদের হাতে ধরা দিয়েছে আয়ের এক উৎসমুল। কাজটি তেমন কঠিন নয়। নিছক হাতপাখা তৈরি করে তা বিক্রি দেওয়া।
বলদী গ্রামে এসে দেখা গেল পূর্বের হতদরিদ্র বর্তমান সময়ে স্বাবলম্বী কয়েকজন পাখা নির্মাণকারী ও বিক্রেতার সঙ্গে। তারা একে একে বর্ণনা করে তাদের সুদিন আসার সংক্ষিপ্ত কাহিনী। জামেনা খাতুন জামু নামে টান বলদীর মধ্য বয়সী এক মহিলা স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে নিজ বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করত। কাপড় দিয়ে শিশুদের পোশাক ও মহিলাদের ব্লাউজ তৈরি করে বিক্রি দিত পাড়ার লোকজনের কাছে। যা আয় হত তা দিয়েই চলত তার সংসার। একযুগ আগের কথা। ভাবনা চিন্তা প্রসারিত হয়ে শুরু করল কাপড়ের নকশা করে বাঁশ দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ। আপন পরিকল্পনায় জামেনা খাতুনের আয়ের পথ সুগম হলো। প্রথমে গ্রামের মহিলা ভিক্ষুকদের হাত দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পর্যানুক্রমে তার বিপণন শুরু করলো গ্রাম থেকে গ্রামে। জামেলা খাতুনের ক্রমবর্ধনশীল এ শিল্পের প্রসার দেখে এলাকার উৎসাহী নারী পুরুষরা অনেকেই তার কাছ থেকে হাতে কলমে শিক্ষা নিয়ে শুরু করেন পাখা তৈরির কাজ। কাজটি লাভজনক বিধায় অল্প দিনের মধ্যে এর বিস্তার ঘটে পুরো বলদী গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী মুখী, দীঘা ও লাউতৈল গ্রামে। আর এখন বলদী গ্রামের মেয়েরা যে গ্রামে বধূ হয়ে যাচ্ছেন সেসব এলাকাতেও ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এ শিল্পের প্রসার। বলদী গ্রামের প্রায় ৬’শ পরিবারের মধ্যে প্রায় সকল পরিবারের এখন প্রধান জীবিকা এ পাখা শিল্প।
আলাপচারিতা হলো পাখা তৈরির শ্রমজীবী রোকেয়া, ফজিলা, মালেকা, নূরজাহান, মর্জিনা, তাজ উদ্দিন, আকবর, নজরুল, আমির আলীসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানালেন, এ পাখাগুলো তৈরি করতে প্রথম দরকার গার্মেন্টসের জুট কাপড়, বাঁশ ও সুতা। উৎপাদন পদ্ধতি হচ্ছে কিছু লোক গার্মেন্টস থেকে জুট কাপড় ও গ্রাম থেকে বাঁশ ক্রয় করে প্রক্রিয়াজাত করে প্রস্ততকারকদের কাছে সরবরাহ করেন। পাখা প্রস্ততকারক নারী ও শিশু শ্রমিকদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শ্রমের বিনিময়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। একজন পাখা শ্রমিক দৈনিক গড়ে ১৫-১৭টি পাখা তৈরি করতে পারেন। এখানে তৈরি হয় তিন ধরণের পাখা। উন্নত পাখার মূল জমিনে নানা রংয়ের সুতা দিয়ে নকশী আঁকা থাকে। নকশীর পাশে মিহি সুতায় গাঁথা থাকে গ্রামীণ শ্লোক, ছড়া ও ভালবাসার ছন্দ। দৃষ্টিনন্দন এ পাখাগুলোর উৎপাদন খরচ ১৫/২০ টাকা। মাঝারি ধরণের পাখায় নকশী বা কারুকাজ থাকে কম এবং এর উৎপাদন খরচ ১০/১২ টাকা। নকশী বা ঝালড়বিহীন সাধারণ পাখাগুলো চলে বেশি। মাত্র ৬ টাকা এর উৎপাদন খরচ। পাখা তৈরির পর শ’ হিসেবে এই পেশায় নিয়োজিত পাইকার ও বিক্রেতারা ক্রয় করেন। প্রতি শ’তে লাভ হয় ৪’শ টাকার উপর। বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এসব পাখা বিক্রি দেন দেশের বিভিন্ন হাটবাজার, শহর বন্দর, পীর ফকিরের মাজার শরীফে ও বাৎসরিক ওরস মাহফিলে। এ গাঁয়ের পাখা বিক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম আইয়ুব আলী, ফয়েজ, মোকলেছ, আক্তার, শহর আলী, রমিজা বেওয়া, শুক্কুরী প্রমুখ।
তারা জানান, পর্যাপ্ত সহায়তা পেলে বলদী, মুখী, লাউতৈল ও রৌহাসহ পাখা পল্লীর এ জনপদের মানুষগুলো এই শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে ভাগ্যের আরো পরিবর্তন করতে পারবে।