সোনালী আঁশ : ঘুড়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশ
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
পাটের যত সম্ভাবনা সবকিছু নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্লাস্টিক ও সিনথেটিক পণ্যের পরিবেশ বিধ্বংসী আগ্রাসন ঠেকাতে পাটের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছে বিশ্বের সচেতন মানুষ। ফলে দেশের এক সময়ের প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের বিশ্বব্যাপী সুদিন ফিরে আসছে। পাটপণ্যের জাগরণ শুরু হয়েছে নতুন করে। মানুষ যত সচেতন হচ্ছে ততই ব্যবহার বাড়ছে পাটের। বাংলাদেশেও সেই হাওয়া লেগেছে। এই তো কয়েক দশক আগে পাটই ছিল আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য। আর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের একমাত্র হাতিয়ারও ছিল এই সোনালি আঁশ পাট। তবে জুটমিল মালিকদের অজ্ঞতা, যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব এবং সরকারের উদাসীনতায় পাটশিল্প সম্ভাবনার শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। বর্তমানে এ শিল্প অন্যান্য পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যাপক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে এ শিল্পে আগের মতো আধিপত্য আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না।
বাংলাদেশের পাটকলগুলোয় এখন যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো অনেক পুরনো। এসব যন্ত্রপাতি মানসম্মত পাটপণ্য তৈরির সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাট শিল্পের আরেকটি বড় সমস্যা, এ শিল্প নিয়ে আমাদের দেশে খুব কম গবেষণা হয়। এ নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন উদ্ভাবনী গবেষণা দেখা যায়নি। বরাবরই খাতটি ছিল অবহেলিত। তাই বিষয়টিতে সরকার দূরদর্শী কোন পদক্ষেপ নিলে এ শিল্পকে আমূল পাল্টে দেয়া যেত। এ শিল্পে আরেকটি বড় সমস্যা দেখা যায় বিপণন নিয়ে। বিপণনের ক্ষেত্রে আমরা কোনভাবেই প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। পাট শিল্পের বিপণনে কীভাবে বৈচিত্র্য আনা যায়, কীভাবে একে পরিবেশসম্মত করে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করা যায় তা নিয়েও ভাবতে হবে।
২০০২ সালে নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুটমিল বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল বাংলাদেশের পাট শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখজনক দিন। এতে ২৫ হাজার লোক চাকরি হারিয়েছিল। শুধু আদমজী নয়, গত কয়েক বছরে আরও কিছু জুটমিল বন্ধ হতে দেখা গেছে। ফলে এক সময়ের সম্ভাবনাময় পাটশিল্প এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে।
এখন পর্যন্ত পাটতন্তু সবচেয়ে সুলভ বলে বিবেচিত। আমাদের দেশে এখনও পাটের আঁশ শুধু ব্যাগ, বস্তা বানানো এবং গুটিকয়েক গৃহস্থালির কাজেই ব্যবহার করা হয়। অথচ পাটের আঁশ দিয়ে মূল্যবর্ধক সুন্দর সুন্দর পণ্য তৈরি করা সম্ভব। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষস্থানীয় হওয়ায় আমরা বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের বহুমাত্রিক ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরতে পারি। পাটতন্তু দ্বারা আকর্ষণীয় শপিংব্যাগ তৈরি করে খুব সহজেই পাশ্চাত্যের দেশে সুলভ মূল্যে রফতানি করা যায়।
গবেষণা সংস্থাগুলোকে পাটপণ্য ব্যবহাওে বৈচিত্র্য আনতে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। কীভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাট চাষ করা যায় এবং পাটকাঠি, পাটতন্তু, পাট, পাটপণ্যের বিপণন করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালাতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন কারখানায় শত বছরের পুরনো মেশিন অপসারণ করে নতুন মেশিন আনতে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। পাটতন্তুর ব্যবহারেও ব্যাপক বৈচিত্র্য আনতে হবে। এগ্রো টেক্সটাইল, জিও টেক্সটাইল, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল ও হোম টেক্সটাইলে পাটতন্তুর ব্যবহার বাড়াতে হবে।
পাটশিল্প অত্যন্ত শ্রমঘন শিল্প হওয়ায় বাংলাদেশ এ থেকে বাড়তি সুবিধা পেতে পারে। পাট উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমিকের মূল্য কম এবং আবহাওয়া ও মাটি পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় খুব সহজেই এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। এতে দেশে বেকারত্বের হার যেমন কমবে, তেমনি আমরা ফিরে পাব হারানো গৌরব।
অবশ্যই স্বীকার্য, পাট শিল্পের ভবিষ্যত এখনও উজ্জ্বল। পাটতন্তু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় যে কোন কৃত্রিম তন্তুর তুলনায় বিশ্বে এর সমাদর রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পাটের নরম আঁশ কাগজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। এ আঁশ ব্যবহার করে বছরে পাঁচ হাজার টন কাগজ তৈরি করা সম্ভব। পাটের নরম তন্তুকে কাগজ শিল্পে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক মেশিন স্থাপন করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী পাট শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে এবং এটিকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া পরিবেশ সচেতনতা বাড়ায় বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। পাটপণ্যের সুদিন ফিরে আসছে। পৃথিবীর অনেক দেশে সিনথেটিক পণ্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। তারা এখন ঝুঁকছে পাটের প্রতি। ভারত আমাদের চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি পাট উৎপাদন করলেও অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে তারা রফতানি করতে পারে না। সুতরাং বিশ্ব বাজারের আগামীর চাহিদা আমাদেরই পূরণ করতে হবে।