মৌমাছি পালন : খাঁটি মধুর ব্যপক চাহিদা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
সারা দেশে এ সময় ১০ থেকে ১২ হাজার পরিবার মৌমাছি পালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে। এ পর্যন্ত পনের হাজার জনকে মৌমাছি পালনের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছি। যারা বাক্সে মৌমাছি পালন করে মধু বাজারজাত করছেন, তারা কিন্তু ভেজাল সৃষ্টি করে না। যা কিছু ভেজাল হচ্ছে তা কিন্তু চাক ভাঙা মধু থেকেই করা হয়…।’ এ কথাগুলো জানালেন মো. আলী আশরাফ খান। তিনি ‘মৌমাছি পালন নির্দেশিকা’ নামে একটি বই লিখে দীর্ঘদিন ধরে মৌমাছি চাষাবাদের ওপর গবেষণা করে যাচ্ছেন।
মৌমাছি পালন সম্পর্কে মো. আলী আশরাফ খান বলেন, মৌমাছি তার খাদ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফুলে বিচরণ করে আর এর ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংঘটিত হয় ‘পরাগায়ন’।
ফলে ফল এবং ফসলের উত্পাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া মৌমাছি দান করে প্রকৃতির উত্কৃষ্ট পানীয় ‘মধু’।
রোগ নিরাময় এবং রোগ প্রতিরোধক হিসেবে মধুর ভূমিকা অনন্য। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাঠের বাক্সে মৌমাছি পালন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
আমাদের দেশে কবে থেকে মৌমাছি পালনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা শুরু হয়েছিল?
এ প্রশ্নের উত্তরে মো. আলী আশরাফ খান বলেন, ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বাগেরহাট জেলার যাত্রাপুরে মৌমাছি পালনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং পালন পদ্ধতি শিক্ষা দেয়ার জন্য সর্বপ্রথম প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজ শুরু করে। মৌমাছি পালন প্রকল্প স্থাপনের জন্য আলাদাভাবে কোনো জায়গার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আনাচে-কানাচে, ঘরের বারান্দায়, ছাদে কিংবা বাগানেও মৌ বাক্স রাখা যায়। এ্যাপিস সেরানা প্রজাতির ৫টি মৌ-কলোনি সংবলিত মৌ খামার স্থাপনের জন্য মোট বিনিয়োগ হবে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। প্রতি বছর গড়ে প্রতি বাক্স থেকে দশ কেজি মধু পাওয়া যাবে, যার মূল্য ২৫০ টাকা হিসেবে দুই হাজার ৫০০ টাকা। এ হিসেবে ৫টি বাক্স থেকে উত্পাদিত মধুর মূল্য দাঁড়াবে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এই আয় ১০ থেকে ১৫ বছর অব্যাহত থাকবে অর্থাত্ প্রথমে মাত্র একবার ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রকল্প স্থাপন করলে মৌ বাক্স এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ১০ থেকে ১৫ বছর ব্যবহার করা যাবে, আর কোনো বিনিয়োগ বা খরচ নেই বললেই চলে।
অপরদিকে এ্যাপিস মেলিফেরা প্রজাতির মৌমাছির ৫টি মৌ-কলোনি সংবলিত মৌ-খামার স্থাপনের জন্য মোট ব্যয় হবে ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকা। এক্ষেত্রেও ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত মৌ বাক্স, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা যাবে, আর কোনো অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে না। মেলিফেরা প্রজাতির প্রতিটি মৌ-বাক্স থেকে বছরে ৫০ কেজি পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা সম্ভব। যার বাজারমূল্য ২৫০ টাকা কেজি হিসেবে ১টি বাক্স থেকে আয় সাড়ে ১২ হাজার টাকা। আর ৫টি বাক্স থেকে আয় হবে সাড়ে ৬২ হাজার টাকা। প্রকল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে মাত্র ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকা এককালীন বিনিয়োগ করে প্রতি বছর ৬০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে আয় করা সম্ভব। মৌ বাক্সের সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধির মাধ্যমে এই আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। স্বল্প পরিশ্রমে এ ধরনের প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে একদিকে যেমন আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়া যায়, তেমনি পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় সহায়তাদানের মাধ্যমে দেশের ফল ও ফসলের উত্পাদনে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা দান করা যায়।
মৌমাছির প্রজাতি সম্পর্কে আলী আশরাফ খান বলেন, সারা পৃথিবীতে প্রধানত ৫ প্রজাতির মৌমাছি দেখা যায়। তার মধ্যে এ্যাপিস সেরানা; এ্যাপিস মেলিফেরা এই দুই প্রজাতির মৌমাছি কাঠের বাক্সে পালনের উপযোগী। এ্যাপিস সেরানা মৌমাছি আকারে মাঝারি, গায়ের রং সোনালি এবং অপেক্ষাকৃত শান্ত প্রকৃতির। সাধারণত এরা গাছের গর্ত, দালানের কার্ণিশ ও সানশেড, ইটের স্তূপ, মাটির গর্তে বাসা বাঁধে। একটা কলোনিতে একাধিক চাক থাকে। প্রতি কলোনিতে একটি রানী, শতাধিক পুরুষ এবং ২৫ থেকে ৩০ হাজার পর্যন্ত শ্রমিক মৌমাছি মিলে এরা কলোনিবদ্ধভাবে বসবাস করে। এদের স্থান ত্যাগের অভ্যাস কম এবং সহজেই পোষ মানানো সম্ভব। বছরে প্রতি উত্পাদনমুখী কলোনি থেকে গড়ে ১০ কেজি পর্যন্ত মধু উত্পাদন হতে পারে।
এ্যাপিস মেলিফেরা মৌমাছি সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ধরনের মৌমাছি ইউরোপীয় মৌমাছি নামে পরিচিত। একটি কলোনিতে একাধিক চাক তৈরি করে থাকে। নির্ধারিত মাপ ও আকৃতির বাক্সে পোষ মানিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ-পদ্ধতি অনুসরণ করে ও সম্প্রসারণের ফলে পৃথিবীতে বর্তমানে সিংহভাগ মধুই উত্পাদিত হচ্ছে এ প্রজাতির মাধ্যমে। আমাদের দেশে এ প্রজাতির মৌমাছির চাষ শুরু হয় ১৯৯৫ সাল থেকে। বিসিক এবং প্রশিকার কর্মীদের দীর্ঘদিনের ক্রমাগত গবেষণা, প্রজনন এবং উন্নত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলেই এ অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এ প্রজাতির মৌমাছির একটি বাক্স থেকে বছরে ৫০ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়।
প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম সম্পর্কে আলী আশরাফ খান বলেন, দুই চেম্বারবিশিষ্ট কাঠের বাক্স লাগে মৌমাছি পালনের জন্য। এই বাক্সেই মৌমাছি রাখা হয়। প্রতি চেম্বারে ৭ থেকে ১০টি কাঠের ফ্রেম থাকে। এই ফ্রেমগুলোতে মৌমাছি চাক তৈরি করে। এছাড়া লাগে মুখোশ, হাতমৌজা, ধুয়াদানা, রানী ধরার খাঁচা, ছুরি, টুল, জলকান্দা, হাতুড়, বাটালি, দা, কোদাল, গামছা বা রুমাল। আর মধু সংগ্রহের জন্য স্টিলের নিষ্কাশন যন্ত্র প্রয়োজন হয়।
মৌমাছি পরিচর্যা সম্পর্কে তিনি বলেন, সাফল্যের সঙ্গে মৌমাছি পালন করতে হলে নির্ধারিত সময় পরপর মৌ কলোনির সার্বিক অবস্থা লক্ষ্য রাখা, পর্যবেক্ষণ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তার সমাধানের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। ঋতুভেদে এই পরিচর্যা ৭ থেকে ১০ দিন পরপর করতে হয়। মৌমাছি পালনের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক শ্রম দেয়ার প্রয়োজন নেই। সপ্তাহে একবার একটি মৌ কলোনির জন্য মাত্র ৮ থেকে ১০ মিনিট সময় ব্যয় করাই যথেষ্ট। মৌ বাক্স রাখার জন্য নির্বাচিত স্থানটি ছায়ামুক্ত, শুকনা ও আশপাশে মৌমাছির খাদ্য সরবরাহের উপযোগী গাছ-গাছড়া দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়া দরকার।
প্রয়োজনে কিছু কিছু ঋতুভিত্তিক গাছ জরুরি ভিত্তিতে লাগানো যেতে পারে। নির্ধারিত স্থানের আশপাশে যেন বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী এবং ধোঁয়া উত্পাদনকারী কোনো কিছু না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মৌমাছির শত্রু ও রোগ সম্পর্কে তিনি জানান, মৌমাছির প্রধান শত্রু হলো মথ পোকা। এছাড়া পিঁপড়া, তেলাপোকা, টিকটিকি, ইঁদুর, পাখি, ফড়িং, শিয়াল, কুনো ব্যাঙ ইত্যাদির হাত থেকে মৌমাছিকে রক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এছাড়া অন্যান্য প্রাণীর মতো মৌমাছি নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এর ফলে মৌমাছির মৃত্যুও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শুককীট এবং মুককীট অবস্থায় মৌমাছি বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস এবং কীটপতঙ্গ আক্রান্ত হয়ে থাকে। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ মৌমাছি একারাইন, আমাশয়, ফাউলব্রুড রোগের নিরাময়কল্পে নির্ধারিত ওষুধ ব্যবহার করতে হয়।