পাখির খামার করে কোটিপতি
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
সালটা ঠিক মনে নেই। ২০০৮ কি ২০০৯ হবে। চাকরি করি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে একটি পানির কারখানায়। রাতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেই টিভিটা চালু করেছি। দেখি, চ্যানেল আইয়ে শাইখ সিরাজের একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। ওই অনুষ্ঠানে বগুড়ার এক যুবক বেশ আত্মপ্রত্যয়ী ভঙ্গিতে তাঁর কোয়েল খামার নিয়ে কথা বলছিলেন। পুরো প্রতিবেদনটি মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। খুবই ভালো লাগল। আমার অন্য সহকর্মীরা সবাই খেয়েদেয়ে তখন ঘুমাচ্ছেন। আমার ঘুম একেবারে পগার পার। আমার মাথায় ঢুকে গেল দেশে ফিরে কোয়েল পাখির খামার করতে হবে। কীভাবে তা করব, বাড়ির কোন পাশে কী করা যায়—সবই কল্পনায় আঁকছি। কল্পনায় কোয়েল পাখির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, নিজেই জানি না।
সকালে আবার কারখানায় কাজে গেলাম। কিন্তু কাজে আর মন বসছে না। মাথায় সারাক্ষণ কোয়েল পাখির চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবছি, কখন দেশে ফিরব, ফিরে গিয়ে কোয়েল খামার করব। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার ফিরে গেলে কখনো আর বিদেশে আসব না। দেশের মাটিতেই তো অনেক কিছু করা সম্ভব। দেশের প্রতি ভালোবাসা যেন আরও বেড়ে গেল। খামারের নাম কী হবে তাও ঠিক করলাম। বিদেশে বসে নাম দিলাম ‘সোনার বাংলা কোয়েল খামার’।
ছয় বছর প্রবাসজীবন শেষ করে দেশে ফিরলাম ২০১১ সালে, মনে কোয়েল পোষার স্বপ্ন নিয়ে। দেশে আসার পর বাবা যখন আমার জন্য পাত্রী দেখতে শুরু করেছেন, আমি তখন খুঁজছি কোয়েল। বাড়িতে মন বসছে না। কোয়েল খুঁজতে ও বুঝতে আমি চলে গেলাম বগুড়ায়। সেই যে টেলিভিশনে দেখেছিলাম, সেখানে কোয়েলের খামারি জামাল ভাইয়ের ডেরায়। তিন-চার ঘণ্টা সময় কোয়েল খামারটিতে কাটালাম। আমার স্বপ্নের কথা জামাল ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তিনি আমাকে অনেক জ্ঞান ও পরামর্শ দিলেন। চতুগুর্ণ উৎসাহ নিয়ে আমি বাড়ি ফিরে এলাম।
বগুড়া থেকে বাড়ি ফিরে শুনি, বাবা আমার জন্য পাত্রী পছন্দ করে ফেলেছেন। দিন-তারিখও ঠিক হয়ে গেছে। নতুন বউয়ের সঙ্গে বিয়ের রাতেই আমার কোয়েল পোষার স্বপ্নের কথা বললাম। কোয়েল পাখির কথা শুনে আমার স্ত্রীও খুশি। তিনি বললেন, আমিও তো পাখি পছন্দ করি। নতুন বউয়ের সঙ্গে আমার পাখি পোষার ব্যাপারটি মিলে যাওয়ায় মনে দারুণ স্বস্তি এল।
২০১২ সালের প্রথম দিকেই আমরা বাড়ির পাশে ২০ শতাংশ জমির ওপর খামার করার পরিকল্পনা করি। বগুড়ার খামারটির আদলে একটি ঘরও বানাই।তিন বছরেই আমার খামারে কোয়েল পাখির সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে গেল। আমার খামার দেখার জন্য দেশের নানা অঞ্চল থেকে খামারপ্রেমিকেরা আসা শুরু করলেন।
বগুড়ার সেই খামারে আবার গিয়ে প্রাথমিকভাবে ৫০০টি কোয়েলের বাচ্চা নিয়ে এলাম। শুরু হলো যত্ন। সৌদি আরবে শুধু স্বপ্নেই কোয়েল পালন করেছি। এবার বাস্তবে গড়ে তুলতে হচ্ছে শখের সেই কোয়েল পাখির খামার। খামার করতে আমার কলেজপড়ুয়া বোন ফাতেমা আমাকে প্রাথমিকভাবে ব্যাপক উৎসাহ ও সহযোগিতা দেয়। আমি বাজারে বা অন্য কোথাও গেলে ফাতেমাই ওই খামার দেখভাল করত।
আমি খুবই আনন্দের সঙ্গে খামারে কোয়েলের যত্ন নিতে থাকি। ধীরে ধীরে কোয়েলের সঙ্গে গড়ে ওঠে আমার বন্ধুত্ব। ওরাই হয়ে ওঠে আমার সব বিনোদনের উৎস। সেখান থেকে প্রতি মাসে যখন উপার্জন হতে শুরু করে, আমার উৎসাহ তখন আরও বেড়ে যায়। বাড়তে থাকে কোয়েলের সংখ্যা। বেড়ে যায় কাজের পরিধি। বেড়ে যায় ব্যস্ততা।
তিন বছরেই আমার খামারে কোয়েল পাখির সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে গেল। সখীপুরে পড়ে গেল ব্যাপক সাড়া। আমার খামার দেখার জন্য দেশের নানা অঞ্চল থেকে খামারপ্রেমিকেরা আসা শুরু করলেন। চেনার সুবিধার্থে পাকা সড়কের পাশে ‘সোনার বাংলা কোয়েল খামার’ লিখে একটা ব্যানার টাঙিয়ে দিলাম। আমার খামারের পরিচিতি বেড়ে গেল। আমার খামার দেখে এলাকার অনেকে নিজেরাও খামার করার চিন্তা করতে শুরু করল। সবাইকে পরামর্শ দিতে দিতে রীতিমতো পেশাদার পরামর্শক বনে গেলাম।
এবার আমার মাথায় নতুন এক চিন্তা ঢুকল। এবার আর খামারের চিন্তা নয়, চিন্তা করলাম কোয়েলকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এবং এর প্রসার ঘটাতে হলে আমাকে হ্যাচারি করতে হবে। আমি ঢাকার সাভার ও গাজীপুরের কয়েকটি হ্যাচারিতে গেলাম। হ্যাচারি করতে হলে সাধারণ কোয়েলের ডিম হলে চলবে না। হ্যাচারির জন্য প্যারেন্টস কোয়েলের (প্রজননক্ষম কোয়েল) ডিম লাগবে। সে অনুযায়ী গাজীপুর থেকে প্যারেন্টস কোয়েল এনে পোষা শুরু করলাম।
২০১৪ সালের শেষ দিকে হ্যাচারির প্রস্তুতি শুরু করলাম। মুরগির মতো কোয়েলেরও ব্রয়লার ও লেয়ার জাত আছে। ব্রয়লার শুধু মাংস খাওয়ার জন্য। আর লেয়ার কোয়েল কেবল ডিম দেয়। প্যারেন্টস কোয়েলের ডিম শুধু বাচ্চা ফোটানোর জন্য।
পশুপাখি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে শুনেছি, কোয়েলের মাংস ও ডিম কোলেস্টেরলমুক্ত, সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যবান্ধব। ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগীরাও এ ডিম খেতে পারে। এক হালি কোয়েলের ডিম ১০-১২ টাকায় বাজারে বিক্রি হয়। অথচ এক হালি মুরগির ডিম কিনতে ৪০ টাকা লাগে। ডাক্তাররা বলেন, কোয়েলের ডিমের আকার ছোট হলেও পুষ্টিমান কম নয়। কোয়েল পরিবেশবান্ধব। লেয়ার জাতের কোয়েল ৪২-৪৫ দিনের মধ্যেই ডিম দেওয়া শুরু করে টানা ১৮ মাস ডিম দেয়। আর ব্রয়লার জাতের কোয়েল ২৮ দিনের মধ্যে বিক্রির উপযোগী হয়। একটি কোয়েল বছরে সাধারণত ২৮০ থেকে ৩০০টি ডিম দিয়ে থাকে। এ ছাড়া কোয়েল পালনে কোনো ঝুঁকি নেই। মুরগির ভ্যাকসিন দিয়েই এর চিকিৎসা চলে।
কোয়েল পুষে আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছি। এখন আমার স্বপ্ন হলো, কোয়েলকে সারা দেশে পরিচিতি করা। লোকজনকে কোয়েলের মাংসের স্বাদে অভ্যস্ত করে তোলা। হাঁস-মুরগির ডিমের পাশাপাশি কোয়েলের ডিম বাজারজাত করা। পুরো বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে নিয়ে আসা, যাতে কোয়েল নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো ভাবতে শুরু করে।একটি ঘটনা বলি। সখীপুর ও টাঙ্গাইলের প্রায় সবাই জানেন, আমি কোয়েলের খামারি। বছর খানেক আগে আমি সখীপুরের কয়েকটি সরকারি ব্যাংকে কোয়েলের হ্যাচারি ও খামারের জন্য ঋণের প্রস্তাব নিয়ে গেলে সে প্রস্তাব পাস হয়নি। কারণ, কোয়েল খামারের নামে ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই। একটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা মাস খানেক পর আমাকে জানান, ঋণ নিতে হলে মুরগির খামারের নামে নিতে হবে। আমি রাজি হইনি। ব্যাংকের ম্যানেজারকে বললাম, আমি তো কোয়েলের খামারি। আমি কেন মুরগির কথা বলে ঋণ নেব।
এবার আমি গেলাম একটি বেসরকারি ব্যাংকে। সেখানকার কর্মকর্তারাও আমাকে মাস খানেক ঘুরিয়ে সরকারি ব্যাংকের মতোই বললেন, কোয়েল পালনের ওপর ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। ঋণ পাওয়া যাবে না শুনে মনটা খুবই খারাপ হলো। আমি ভেবে দেখলাম, কোয়েল পালনের ব্যাপারটা যদি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সরকারকে এ নিয়ে ভাবতে হবে। তখন কোয়েল চাষের জন্যও ঋণের ব্যবস্থা হবে। বেকার যুবকেরা তখন ঋণ নিয়ে কোয়েলের খামার করতে পারবেন।
কোয়েল খামার থেকে আমার মাসে এক থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত আয় হয়। আমার তো আর বিদেশে যাওয়ার কোনো দরকারই নেই। কোয়েল চাষকে আমি বাংলাদেশে জনপ্রিয় করতে চাই। কীভাবে খামার ও কোয়েলের যত্ন নিতে হয়, তা নিয়ে আরও গবেষণা করে একটি বইও লেখার ইচ্ছা আছে। বইটিতে কোয়েল চিকিৎসা নিয়ে একজন চিকিৎসকের মতামত ও টিপসও থাকবে। আরও থাকবে কোয়েল নিয়ে অনেক তত্ত্ব ও তথ্য; পাশাপাশি সফল কোয়েল খামারিদের কথা।
আমার খামারে ছয়জনের একটি কর্মীবাহিনী কাজ করে। আমার মা, বোন ও স্ত্রী—এদের সবাই আমার খামারের অংশ। কোয়েল পোষার পাশাপাশি ছয় মাস ধরে আমি প্যারেন্টস মুরগির (প্রজননক্ষম মুরগি ও মোরগ) খামারও করেছি। ওই খামারে ১ হাজার ১০০ মোরগ-মুরগি রয়েছে।
ছয়-সাত মাস ধরে চালু করা হ্যাচারি থেকে প্রতি মাসে ৪০-৫০ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করছি। টাঙ্গাইল বাদ দিয়েও দেশের আট-দশটি জেলার বিভিন্ন খামারে আমার হ্যাচারি থেকে বাচ্চা যাচ্ছে। ঢাকা ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন হোটেলে ব্রয়লার কোয়েলের মাংস সরবরাহ করছি। কোয়েলের মাংস জনপ্রিয় করে তুলতে কাজ করছি। ঢাকার কিছু নামকরা চেইনশপ ও হোটেলের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলেছি। বিয়েশাদিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কোয়েলের রোস্ট সরবরাহের কথাও মাথায় আছে।
আমার নাম শামীম। বহু মানুষ মোবাইল ফোনসেটে কোয়েল শামীম লিখে আমার নাম সংরক্ষণ করছে। নিজের গ্রামেও অনেকে বলে, ‘শামীমকে চেনো, ওই যে কোয়েল শামীম। কোয়েলের খামার করেছে যে ছেলেটা।’ শুনে বড় ভালো লাগে।
শামীম আল মামুন: কোয়েল খামারি, সখীপুর টাঙ্গাইল
সূত্র: প্রথম আলো