সংরক্ষণযোগ্য মিশ্র ফলের আবাদ বাড়ছে পার্বত্যাঞ্চলে
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
উচ্চমূল্যের মিশ্র ফল আবাদে আগ্রহ বাড়ছে পার্বত্যাঞ্চলের চাষীদের। আম, কলা, কাঁঠাল, আনারসসহ উদ্যান ফসলের পাশাপাশি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণযোগ্য মিশ্র ফলের দিকে ঝুঁকছেন তারা। এদিকে পাঁচ বছরে তিন পার্বত্য জেলার ছয় হাজার হেক্টর জমি মিশ্র ফলের আওতায় আনার প্রকল্প নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে উদ্যান ফসল চাষে দেশীয় করপোরেটদের আগ্রহ বেড়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় আমসহ নানা ধরনের ফলের আবাদ করে সাফল্য পেয়েছে। তবে প্রক্রিয়াকরণের সুযোগ না থাকায় প্রায় ৫০ শতাংশ ফলই নষ্ট হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকটি উচ্চ মূল্যমানের ফল চাষে সাফল্য আসায় সরকারের পাশাপাশি কৃষকরাও এগিয়ে আসছেন। এরই মধ্যে কাজুবাদাম, কমলা, মাল্টা, ড্রাগন ফল, কলম্বো লেবু, সাতকরাসহ বেশ কয়েকটি জাতের দামি ফল আবাদ বাড়িয়েছেন কৃষকরা।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি মিশ্র ফল প্রকল্পটি শুরু হয়েছে চলতি বছরের মে থেকে। ২০২০ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের উপকারভোগী হিসেবে তিন পার্বত্য জেলার পাঁচ হাজার পরিবারকে বীজ, কৃষি উপকরণ ও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রতিটি গ্রামের ১০টি পরিবারকে সুবিধাভোগী হিসেবে প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
ডিএই সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭-০৮ মৌসুমে পার্বত্য তিন জেলায় ৬৩ হাজার ৭৬৭ হেক্টর উদ্যান জমিতে ফল উত্পাদন হয়েছিল ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬৩ টন। ২০১৪-১৫ মৌসুমে ৯৭ হাজার ৬৮৪ হেক্টর জমিতে ফল উত্পাদন হয় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ৫৩০ টন। এ হিসাবে গত আট বছরে পার্বত্য তিন জেলায় উদ্যান ফসলের চাষ বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। এর বিপরীতে উত্পাদন বেড়েছে ৫১ শতাংশ। সর্বশেষ মৌসুমেও উদ্যান ফসলের চাষ ও উত্পাদন দুটোই বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে জুমের বিপরীতে উদ্যান ফসল পার্বত্যাঞ্চলের কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
ডিএই তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরেও পার্বত্য এলাকায় চাষকৃত ফলের পরিমাণ ছিল ৩৫টির বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এসে চাষকৃত ফলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬-এ। এর মধ্যে কাজুবাদাম, ড্রাগন ফল, মাল্টা, উন্নত জাতের খেজুর, স্ট্রবেরি, সাতকরা চাষে যুক্ত হয়েছেন এ অঞ্চলের কৃষক। উত্পাদনের পর দীর্ঘ সময় পচনরোধী থাকায় এসব ফল উত্পাদন করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
প্রতি হেক্টর জমিতে কাঁঠাল, আম, কলা ও আনারস উত্পাদনে যে খরচ, তার চেয়ে বেশি লাভ হয় মিশ্র ও অন্যান্য ফল আবাদে। প্রতি মণ কাজু বাদাম উত্পাদনে কৃষক পর্যায়ে ৪-৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। অন্যদিকে প্রতি কেজি ড্রাগন ফল চাষে লাভের হার ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এছাড়া মাল্টা, কলম্বো লেবু, সাতকরাসহ বিভিন্ন মিশ্র ফল চাষে লাভ তুলনামূলক বেশি হওয়ায় কৃষকরাও এতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
মিশ্র ফল প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আবহাওয়া ফল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। দীর্ঘদিন ধরে শুধু জুম চাষের ওপর নির্ভরতার কারণে ফলের আবাদে অনাগ্রহী ছিলেন এ অঞ্চলের কৃষক। জুমের ফলন কমে যাওয়ায় অর্থকরী ফসলের দিকে ঝুঁকছেন তারা। তবে ওজন বেশি ও দ্রুত পচনশীল হওয়ায় অধিকাংশ ফলের ন্যায্যমূল্য পান না কৃষক। ফলে অধিক সময় টিকে থাকে এবং উচ্চমূল্য পাওয়া যায়— এমন ফসলের চাষ বাড়িয়েছেন তারা।
তিনি জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বিদেশী আরো কয়েকটি নতুন ধরনের ফল চাষের বিষয়ে পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। ভালো মানের বিদেশী উন্নত জাতের ফলন বাড়তে থাকলে এ অঞ্চলের কৃষির ধরন পাল্টে যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
কৃষিবিদরা জানিয়েছেন, পার্বত্য এলাকায় প্রতি বছর প্রায় এক লাখ টন হারে ফল উত্পাদন বাড়ছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ সময় পার্বত্যচাষীদের নিজেদের ভোগে পরিণত হয় ফল। রাঙামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে উত্পাদিত ফসল সবচেয়ে কাছের বাজারে এনে বিক্রি করতে দু-তিনদিন লাগে কৃষকদের। দুর্গম এসব এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে বেশি ওজনের ও দ্রুত পচনশীল ফল বাজারে এনে বিক্রি করতে কৃষকের আগ্রহে ভাটা পড়ে। কিন্তু কাজুবাদামসহ বেশ কয়েকটি ফল উত্পাদন করলে কৃষক নিজের মতো করে বাজারে এনে বিক্রি করতে পারেন। নারকেল, খেজুরসহ অন্যান্য ফল চাষ করলে চাষীদের খাদ্যনিরাপত্তাও বেড়ে যায়।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আলতাফ হোসেন জানান, পার্বত্য তিন জেলা কলা, আম ও কাঁঠাল চাষের সর্বোত্তম স্থান। প্রতি বছর এসব ফলের চাষ বাড়ছে। তবে জুমের জমিতে বিকল্প হিসেবে মিশ্র ফলের চাষ বাড়াচ্ছেন কৃষকরা। বৈচিত্র্যময় ফলের জন্য আগামীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নতুন রূপে হাজির হবে বলে মনে করেন তিনি।