বাঁশিতে বৈদেশিক মুদ্রা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের অর্ধশত পরিবার মোহন, মরালী, মুখ, নাগিনী, ক্যালেন কিংবা পাখি এমনসব শ্রুতিমধুর নামের বাঁশি তৈরি করে বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে বাংলার বাঁশির নাম। শুনতে অবাক লাগলেও ঘটনা সত্যি। বাংলাদেশের তৈরি বাঁশি রফতানি হচ্ছে বিদেশে আর আনছে বিদেশী মুদ্রা। বাঁশি রফতানি হচ্ছে- সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন, জাপান, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। জানা গেছে বংশ পরম্পরায় প্রায় ৫০ বছর ধরে এ শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুই-তিন হাজার লোক। দেশের বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে বাঁশি বিক্রি হয় বেশি। চিরায়ত এ ঐতিহ্য সংরক্ষণে কুমিল্লার হোমনার শ্রীমদ্দি এলাকার পরিচিতি রয়েছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। হোমনায় খ্যাতনামা কোন বাঁশরিয়া না থাকলেও রয়েছেন অসংখ্য বাঁশির কারিগর যাদের হাতে তৈরি বাঁশিতে সুর তুলে খ্যাতিমান হয়েছেন অনেকে।
গল্প-উপন্যাসের রাজকন্যারা যে বাঁশির সুরে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে কুঁড়ে ঘরের বামনের হাত ধরে চলে আসতেন সেই বাঁশিটির নামও ঐতিহ্যবাহী নামে পরিচিত-‘রাজ, নবাবী, শাহীবাঁশি। হালের সিনেমায় মডার্ন মেয়েদের হৃদয় তোলপাড় করে, এর নাম প্রেমের বাঁশি। প্রেমের বাঁশি তৈরিতে নানা বাহারি ডিজাইনের লেসফিতা, জরি, কেমিক্যাল গ্রেজ দেয়া হয়। কবি নজরুল ইসলামের বিষের বাঁশি উপন্যাসটি লিখেছিলেন আর বাঁশিকে কেন্দ্র করে, যা তার বিভিন্ন ছবিতে বাঁশিসমেত কবিকে দেখা যায়।
ইতিহাস ও টিকে থাকার সংগ্রাম ॥ অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ১২৫ বছর আগে গ্রামের কোকিল দাস বৈরাগী ও দীনবন্ধু প্রথম বাঁশি তৈরি করেন। ভারতের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত ছিল তাঁদের। দুজনই চমৎকার বাঁশি বাজাতেন। সেখান থেকে দেখে এসে বাঁশি তৈরি শুরু করেন তাঁরা। প্রথমদিকে অল্প কিছুসংখ্যক বাঁশি তৈরি করে নিজেরাই ফেরি করে বিক্রি করতেন। তাঁদের কাছ থেকে অন্যরা এ কাজ শেখেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে কোকিল দাস ও দীনবন্ধু সপরিবারে স্থায়ীভাবে ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার আগে বাঁশির বাজার অনেক ভাল ছিল। চৈত্র মাস এলে ঢাকার চকবাজারে এক থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত বাঁশি বিক্রি হতো। সেসময় খুলনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেই সময় চিঠি লিখে বাঁশির অর্ডার দিতেন ব্যবসায়ীরা। পূর্বপুরুষদের সৃষ্টিশীল এই কাজটির পরম্পরা ধরে রাখতে পেশার অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষ।
বাঁশির গ্রাম শ্রীমদ্দি নাম ॥ কুমিল্লার হোমনা অঞ্চলের শ্রীমদ্দি বাঁশি পল্লী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে পুরো জেলায়। বাঁশ আর বাঁশিই তাদের ব্যবসা ও জীবন। ৫০ বছর ধরে চলছে এই কর্মযজ্ঞ। দেশের যেখানেই মেলা হয়, সেখানেই পাওয়া যায় হোমনার বাঁশি। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের অর্ধশত পরিবারের দুই-তিন হাজার লোক এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাদের নিপুণ হাতে তৈরি বাঁশের বাঁশির কদর রয়েছে দেশ-বিদেশে। সারা বছর সংসারের অন্যান্য কাজকর্মের পাশাপাশি বাঁশি তৈরি করলেও বৈশাখী মেলাকে সামনে রেখে ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাস বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাঁশি তৈরি করেন তারা। গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত থাকেন বাঁশ কাটা, চাঁচা-ছোলা, রোদে শুকানো, নকশা করা, আগুনে পোড়ানো, রং করার কাজে। এসব কাজ শেষে পাইকারি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বাঁশি বিক্রি ও পাঠানোতেও দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, নাটক-সিনেমা বা সঙ্গীত জগতের বিখ্যাত বংশীবাদকরা এর জন্য অগ্রিম অর্ডার দিয়ে বাঁশি কিনে নিয়ে যান। শ্রীমদ্দি থেকে স্পেশাল বাঁশি নিয়ে ব্যবহার করছেন দেশের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীরা। এখানকার বাঁশিগুলো নিপুণ হাতের শৈল্পিক সৌন্দর্য রয়েছে মানসম্মত। সারা বছর প্রায় ৩০ লাখ বাঁশি তৈরি হয় হোমনায়।
বাঁশি আনছে বিদেশি মুদ্রা ॥ হোমনার বাঁশির জয়জয়কার এখন বিশ্বজুড়ে। হোমনায় তৈরি নকশি বাঁশি রফতানি হচ্ছেঃ সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন, জাপান, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। এখানকার উন্নতমানের বাশের বাঁশি মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্কসহ ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রের আধুনিক প্রযুক্তিকে হার মানিয়ে বিশ্ব বাঁশরিয়াদের হৃদয় জয় করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শ্রীমদ্দির বাঁশি তৈরির কারিগররা তোতা (মুখ), মোহন, ফেন্সি, খানদানি, ক্লাসিক্যাল, নাগিন, স্পেশাল, বীণ, শাহী, নবাবী, রাজ ও প্রেমের ও বেলুন বাঁশি তৈরি করেন। ঢাকার কিছু ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে বাঁশির অর্ডার নিয়ে তা তৈরির জন্য তাঁদের নমুনা সরবরাহ করেন। তাঁরা নমুনামতো তৈরি করে দেন মোহনীয় বাঁশি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হস্ত ও কুটির শিল্প শাখার সূত্রে জানা যায়, বাঁশি রফতানি করে প্রতিবছর অর্ধকোটি টাকা আয় হয়।
বৈশাখে বাঁশির কদর ॥ বৈশাখ এলে বাঁশির কদর বেড়ে যায় বহুগুণে। সারাবছর যে পরিমাণ বাঁশি তৈরি হয় তার চেয়ে বেশি বাঁশি তৈরি হয় চৈত্র মাসে নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখী মেলাগুলোতে। বৈশাখের কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আবাল-বৃদ্ধ-হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দি কালীবাড়ির মেলা, কচুয়ার সাচারের রথমেলা, ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের বেলতলীর লেংটার মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খরমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলী খেলা, নাঙ্গলবন্দের অষ্টমী স্নান, সাতক্ষীরার পূজার মেলায় প্রচুর বাঁশি বিক্রি হয়।
ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে অবিলম্বে আর্থিক সমস্যা সমাধানে কারিগরদের কম সুদে ঋণ দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারকে পাশে চান বাঁশি কারিগররা। আমাদের প্রত্যাশা সরকার সদাশয় ব্যবস্থা নেবে।