পোশাক খাতে নতুন সম্ভাবনা
- এস এম মুকুল
সারাবিশ্বের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর পছন্দের পোশাক ডেনিম। জিন্সের এমন জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতার মূল কারণ, এতে ব্যবহৃত ডেনিম কাপড়। তৈরি পোশাক খাতে নতুন এক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ডেনিম বা জিনস পণ্যে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের ডেনিমের সম্ভাবনা দিনকে দিন বাড়ছেই। ডেনিম খাতে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ বাড়ানোর কারণে বিদেশী ক্রেতারা আগ্রহী হচ্ছেন বাংলাদেশের ডেনিমের প্রতি। আশার খবর হচ্ছে- তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় স্থানের পাশাপাশি ডেনিম রফতানিতে তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। ইউরোপ আমেরিকার কিশোর, তরুণ-তরুণী এমন বয়স্কদের পরিহিত জিন্সটির গায়ে ছোট লেবেলে মেড-ইন-বাংলাদেশ- লেখা দেখতে পাওয়া এখন খুবই সাধারণ ব্যাপার। একটা সময়ে জিন্স মানেই ছিল অনেক মোটা কাপড় আর শীতের সময়ে আরামদায়ক এমন পোশাক। কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে জিন্স। এখন জিন্সের প্যান্ট অনেক পাতলা ও নরম কাপড়ের হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে অনেক। রং ও সুতার ব্যবহারে এখন মাথায় রাখা হয় ঋতু। তাই শীত-গ্রীষ্ম সব সময়ই জিন্স আরামদায়ক। জিন্স হলো ডেনিম কাপড়ে তৈরি প্যান্ট বা ট্রাউজার্স। অনুসন্ধানে জানা গেছে- মূলত শ্রমিকদের জন্য নির্মিত এই প্যান্ট ১৯৫০-এর দশক থেকে কিশোরদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরে জিন্স সবার কাছেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জানা গেছে, বর্তমান বিশ্বে ডেনিমের বাজার কমবেশি ৫৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে এর বাজার ৬৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়ছে বাংলাদেশী ডেনিমের
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ডেনিম পোশাকের কদর বাড়ছে। উন্নতমানের ডেনিম রফতানি, বিশ্বমানের কারখানা এবং শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের ফলে এই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ডেনিমে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলো-চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। তবে উচ্চমূল্যের ডেনিম কাপড় উৎপাদনে তুরস্কের বিশেষ সুনাম রয়েছে। পাশাপাশি ডেনিম উৎপাদনে বাংলাদেশও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রতিবছর ডেনিম কাপড় উৎপাদনে দেশের সক্ষমতা রয়েছে ৩৬ কোটি গজ। আর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৬০-৬৫ কোটি গজ। চাহিদার অর্ধেকের কম কাপড় উৎপাদিত হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে এ চাহিদা ১২০ কোটি গজে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। সুতরাং এ খাতে বিনিয়োগের ব্যাপক জায়গা রয়েছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে- ডেনিম কাপড় তৈরির জন্য দেশে ২৬টির বেশি কারখানা আছে। আরও ১৭টি কারখানা তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রায় ৪০০ পোশাক কারখানায় ডেনিম থেকে পোশাক তৈরির মাধ্যমে রফতানি করে। এই শিল্প খাতে বিনিয়োগ ৮৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশের ডেনিমই বিশ্বসেরা
সাশ্রয়ী দাম আর গুণগতমানে সেরা বলে বাংলাদেশের ডেনিম বিশ্বব্যাপী বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে ডেনিমের বাজার সম্পর্কিত বিভিন্ন সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে প্রথম হংকং ও ফিলিপিন্সের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে ডেনিম পোশাক তৈরির দুটি কারখানা স্থাপন করে। ১৯৯২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ বিশ্বের ১১তম ডেনিম সরবরাহকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর আগের বছরের তুলনায় সরবরাহ ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়াই মেলে এ স্বীকৃতি। পরে ১৯৯৬ সাল থেকে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় ডেনিম কাপড়ের ওপর নির্ভর করতে শুরু হয়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে ১৭ কোটি পিসের বেশি ডেনিম পোশাক বিক্রি করে আয় করেছে প্রায় ৯৪ কোটি ডলার। একই সময়ে চীন একই বাজারে বিক্রি করে মাত্র সাড়ে ১১ কোটি পিস। ডেনিমের বিশাল বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে- উদ্যোক্তাদের মতানুযায়ী বাংলাদেশের ডেনিমই বিশ্বসেরা। দেশের ডেনিম পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ৬০ শতাংশ কাপড়ই আমদানি করতে হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। আশার খবর হচ্ছে উচ্চমান ও মূল্যের পাশাপাশি ফ্যাশনেবল ডেমিনের উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছে এ শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের আছে বিশের অধিক ডেনিম কারখানা। এর অর্ধেকেরও বেশি এখন উৎপাদন ক্ষমতা সম্প্রসারণে নেমে গেছে। আরও আধুনিক ডেনিম-ফ্যাশন ডেনিম বা প্রিমিয়াম ডেনিম- উৎপাদনের জন্য আধুনিক মেশিনারী স্থাপন করছে। গত ৫-৭ বছরে স্থাপিত হওয়া ডেনিম কারখানাগুলো বেশিরভাগ এমনিতেই অনেকটা অগ্রসর প্রযুক্তি নিয়ে স্থাপিত। দেশের বৃহত্তম পারটেক্স ডেনিম এর উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে উদ্যোক্তা। স্কয়ার ডেনিম দীর্ঘদিন ধরেই সুতা উৎ্পাদন করে আসছে। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের অলিপুরে প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে স্কয়ার ডেনিম লিমিটেডের ডেনিম ফেব্রিকস উৎপাদনের বিশাল কারখানা।
ডেনিমওয়্যারের ভবিষ্যত বিশাল
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে, আর ডেনিম রফতানিতে এখন তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির অভিযাত্রা শুরু হয় আমেরিকান এক আমদানিকারকের উদ্দেশ্যে কয়েক হাজার ডলারের এক কনসাইনমেন্ট শার্ট রফতানি দিয়ে। কালক্রমে তৈরি পোশাক শিল্পই এনেছে মোট রফতানি আয়ের প্রায় আটাত্তর শতাংশ- সাড়ে বারোশ’ কোটি মার্কিন ডলার বা সাতাশি হাজার কোটি টাকা। শিল্প সংশ্লিষ্টদের আশা ডেনিম শিল্পের অভিযাত্রা সফল হলে এ দশকেই বার্ষিক লাখো কোটি টাকা আয় হতে পারে। বিশ্ববাজারে ডেনিমের বর্তমান বাজারের আকার ৫৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সাল নাগাদ এটি ৬৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে চাহিদা বাড়বে আট বিলিয়ন ডলারের যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ববাজারের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে ধরা দেবে বিশাল সাফল্য। ডেনিমওয়্যারের পরিমাণগত রফতানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। গড়ে কম মূল্যের ডেনিম পোশাক রফতানি করে বলেই বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব ডেনিম বাজারে তার শেয়ার শতকরা চার শতাংশেরও কম। তুরস্ক, তিউনিশিয়া বা মেস্কিকোর মতো উন্নত ও দামী ডেনিমের ফ্যাশন জিন্স রফতানি করতে পারলে বর্তমান পরিমাণেই আয় হতো এখনকার দ্বিগুণ। পরিমাণ বাড়লে আরও শত কোটি বা হাজার কোটি মার্কিন ডলার আয় হতো। আট হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বিশ্ববাজার ডেনিম পোশাকের, আর সেখানে বাংলাদেশের ডেনিম পোশাক রফতানি প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি মার্কিন ডলার।
২০২১ সাল ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা
বাংলাদেশ ২০১৪ সালে ১ কোটি ৮৫ লাখ ডেনিম পোশাক রফতানি করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৪ কোটি ৪৩ লাখ পিস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১৪ কোটি ১০ লাখ পিস ডেনিম পণ্য (জিনসের প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট, ব্লেজার ইত্যাদি) রফতানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এসব পণ্য রফতানি থেকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ২৫০ কোটি ডলার। বর্তমানে ডেনিমের দুটি প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদার যথাক্রমে ২২.৮৮ ও ১১.৩৫ শতাংশ পূরণ করে বাংলাদেশ। বিশ্বে বছরে ডেনিমের বাজার প্রায় ৮ হাজার কোটি ডলারের। বছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ ডেনিম পণ্য রফতানি করছে ৩৫০ কোটি ডলারের। বছরে ডেনিম পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের ওপরে।
তথ্যানুযায়ী বর্তমানে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশই সেরা ডেনিমের রফতানিকারক দেশ। জানা গেছে, বিশ্ববাজারে ডেনিম পণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় সোয়া ২শ’ কোটি পিস। তবে বর্তমানে রফতানি হচ্ছে ২০ কোটি পিস ডেনিম পণ্য। সব মিলিয়ে দেশের কারখানাগুলোর মাসিক ডেনিম কাপড়ের চাহিদা সাড়ে চার কোটি মিটার। বিশ্বে ডেনিমের বাজার প্রায় ৫ হাজার ৬২০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবদান ২৫০ কোটি ডলার।
বিশ্বে বাংলাদেশের ডেনিমের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ডেনিম পণ্য রফতানি করে বছরে ৫০০ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ডেনিম পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয়। দেশে ডেনিম পণ্য তৈরি করে এমন কারখানার সংখ্যা সোয়া ৫শ’। এসব কারখানার বেশিরভাগই আমদানিকৃত কাঁচমালের (ফেব্রিক) ওপর নির্ভরশীল। দেশে ডেনিমের ফেব্রিক্স তৈরি করে এমন কারখানার সংখ্যা ২৭টি। আরও ১৭টি কারখানা তৈরি হচ্ছে। এই খাতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেছেন ৮৩৪ মিলিয়ন ডলার। প্রতিবছর ডেনিম কাপড় উৎপাদনে দেশের সক্ষমতা রয়েছে ৩৬ কোটি গজ। চাহিদা রয়েছে প্রায় ৬০-৬৫ কোটি গজ। ২০২১ সালের মধ্যে এই চাহিদা ১২০ কোটি গজে দাঁড়ালে রফতানি আয়ের আশা করা হচ্ছে ৭০০ কোটি ডলার। সুতরাং এ খাতে বিনিয়োগের ব্যাপক জায়গা রয়েছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।