অর্থনীতির সঙ্গী বাংলাদেশের লুঙ্গি
- এস এম মুকুল
লুঙ্গি ছাড়া বাঙালী পুরুষদের দিন চলেই না। আরামদায়ক আর ঢিলেঢালা হওয়ায় লুঙ্গির ব্যবহার বাঙালী পূর্বপুরুষদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। সেই থেকে যুগপরিক্রতায় বাঙালী পুরুষদের নিত্যদিনের আরামদায়ক লুঙ্গি। বোতাম নেই, দড়ি নেই, বেল্ট নেই, ফিতা নেই, সেফটিপিন নেই, চেইন নেই- লুঙ্গি একটা অপূর্ব আশ্চর্য জিনিস। লুঙ্গিকে ফুটপাথের সাধারণ ব্যবহার্য পণ্য হিসেবে তাচ্ছিল্য করার দিন অনেক আগেই ফুরিয়েছে। আধুনিক সভ্যতায়, প্রযুক্তির পরশের পরিবর্তন লেগেছে লুঙ্গির গায়েও। লুঙ্গি নিসন্দেহে বাঙালীর আভিজাত্যের প্রতীক। লুঙ্গি পড়ার মাঝে শুধু আরাম নয়- আছে নান্দনিকতা এবং শৈল্পিকতার ব্যাপার। অনেকের ধারণা, এ যুগের আধুনিক তরুণরা এখন আর লুঙ্গি পরে না- তাই বুঝি লুঙ্গির দিন শেষ হয়ে আসছে। কথাটি মোটেও সত্য নয়। বরং লুঙ্গির চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছেই এবং নিজস্ব ব্র্যান্ডের স্বতন্ত্র পরিচয়ে শুধু দেশে নয় বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের লুঙ্গি।
দেড় হাজার কোটি টাকার স্থানীয় বাজার
সাম্প্রতিক ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে লুঙ্গির বাজারের। রং ও ডিজাইনে বৈচিত্র্যে লুঙ্গি সবার কাছে আকর্ষণীয়, আরামদায়ক পরিধেয়। একসময় নামে-বেনামে বিক্রি হওয়া লুঙ্গি এখন পরিচিতি পাচ্ছে নিজস্ব ব্র্যান্ডে। তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে দেশে প্রথম লুঙ্গির ব্র্যান্ডিং শুরু করে হেলাল এ্যান্ড ব্রাদার্স। এরপর স্ট্যান্ডার্ড এবং আমানত শাহ, এটিএম, অনুসন্ধান, পাকিজা, বোখারি, সোনার বাংলা টেক্সটাইল, ডিসেন্ট, ইউনিক, রুহিতপুরী, স্মার্ট, ফজর আলী, অনুসন্ধান, জেএম, স্কাই, ওয়েস্ট, রংধনু, অমরসহ ১২৫ ব্র্যান্ডের লুঙ্গি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। উদ্যেক্তাদের অভিমত, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভাল মানের লুঙ্গি তৈরি হয় বাংলাদেশে। দেশের বাইরে লুঙ্গির চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে লুঙ্গির দেশীয় চাহিদা বার্ষিক প্রায় সোয়া দুই কোটি পিস। এখন ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি হচ্ছে বিদেশী চেইনশপেও। সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন তথ্য কিবশ্লেষণে দেখা গেছে- দেশের প্রায় চার কোটি লোক লুঙ্গি অন্তত দুটি করে লুঙ্গি পরে। সে অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে বার্ষিক লুঙ্গির চাহিদা প্রায় আট কোটি পিস, যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের লুঙ্গি
বাংলাদেশের লুঙ্গির দিকে এখন নজর বিদেশীদেরও। ব্যবসায়ীদের অভিমত, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের লুঙ্গির মান সবচেয়ে ভাল। এ কারণে রফতানিতেও অনেক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। রঙে, ডিজাইনে, গুণগত মানে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লুঙ্গি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের মতানুযায়ী, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহারাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের ২৫টি দেশে কর্মরত প্রায় এক কোটি লোকের চাহিদার আলোকে দেশের লুঙ্গির একটি রেডি মার্কেট আছে। বাঙালীরা লুঙ্গির প্রধান ক্রেতা হলেও ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশের লোকজন এখন শখ করে বাংলা-দেশী লুঙ্গি পরে। সুবাদেই লুঙ্গি রফতানির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের মতানুযায়ী, ফিলিপিন্স, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যে বহু মানুষের নিত্যদিনের পোশাক লুঙ্গি। ঐসব দেশের লুঙ্গি মান, ধরন ও নকশা বাংলাদেশী লুঙ্গির চেয়ে ভিন্ন হলেও বাজার ধরতে তাদের উপযোগী লুঙ্গি তৈরি করে রফতানি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ২৫টি দেশে প্রায় দুই কোটি পিস লুঙ্গি রফতানি করে বছরে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বাংলাদেশ। প্রতি বছরই রফতানির পরিমাণ বাড়ছে। জানা গেছে, বাংলাদেশী লুঙ্গির বড় ক্রেতা ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। ভারতীয় আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ পিস লুঙ্গি কিনে নেয়। তারা বাংলাদেশ থেকে লুঙ্গি ভারতে নিয়ে পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও দিল্লীস্নতে মজুদ করে। তারপর ভারতের বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানে স্টিকার লাগিয়ে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, লেবানন, ওমান, বাহারাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করে।
বাবুরহাটের লুঙ্গি বাজার
দেশের অন্যতম শাড়ি, লুঙ্গি ও অন্যান্য দেশীয় বস্ত্র কারখানাগুলো নরসিংদীকেন্দ্রিক। তাই এসব বস্ত্র কোম্পানিগুলোর প্রধান শোরুম রয়েছে বাবুরহাটে। একসময় নরসিংদী, কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর, দোহার, নবাবগঞ্জ ও শ্রীনগরের হস্তচালিত তাঁতের তৈরি লুঙ্গি প্রসিদ্ধ ছিল। ১৯৯৮ সালের দিকে যন্ত্রচালিত তাঁতের লুঙ্গি এই শিল্পে নতুন পথ খুলে দেয়। এখন যন্ত্রচালিত তাঁতেই চাহিদার ৯৫ শতাংশ লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। জানা গেছে, ছোট-বড় মিলিয়ে লুঙ্গি উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সহস্রাধিক। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নরসিংদী জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে লুঙ্গি প্রস্তুতকারক ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার। কথার প্রচলন আছে লুঙ্গি মানেই বাবুরহাটের লুঙ্গি। গুণে-মানে ভাল থাকায় ক্রেতাদের কাছে বাবুরহাটের লুঙ্গির কদর ব্যাপক। লুঙ্গির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বসে নরসিংদীর বাবুরহাট, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। এসব বাজার থেকেই সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা লুঙ্গি কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন।
লুঙ্গি শিল্পের গ্রাম তামাই
তামাই সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার একটি গ্রামের নাম। লুঙ্গি শিল্পের গ্রাম। এই গ্রামের সঙ্গে তাঁতের সম্পর্ক যেন নাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। কারণ গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে তাঁত। জানা গেছে- বাংলাদেশে উৎপাদিত লুঙ্গির ৬০ শতাংশই এই গ্রামে তৈরি হয়। শোনা যায়, সুদূর অতীতে এখানকার উৎপাদিত এক ধরনের সূক্ষ্ম ও মিহি উরাণী চাদরের প্রসিদ্ধি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাবনা জেলার ইতিহাস প্রায় ১০০ বছর আগের তামাইয়ের তাঁতের সংখ্যা ছিল ৫০০টি। বর্তমানে এই সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামটিতে দৈনিক লুঙ্গি উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১ লাখের মতো। পাকিজা, আমানত শাহ, স্ট্যান্ডার্ড, এটিএম, অনুসন্ধান, সম্রাট, মেমোরি, ফজর আলী, হিমালয়, পপুলারের মতো বাংলাদেশের যতো নামী লুঙ্গির ব্র্যান্ড রয়েছে, তারা সবাই এ গ্রাম থেকে লুঙ্গি কিনে থাকে। পরে নিজস্ব লেবেল লাগিয়ে সেগুলো বাজারজাত করে। তাছাড়া তামাই গ্রামের লুঙ্গি ভারত, ফিলিপিন্স, নেপাল, বার্মা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি হয়।
লুঙ্গির হাট-বাজার
বাংলাদেশের বৃহত্তর পাবনাসহ কয়েকটি জেলার তাঁতিদের তৈরি লুঙ্গির সুনাম ও কদর দেশের গ-ি পেরিয়ে এখন বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়ার কুমারখালী হস্তচালিত তাঁতশিল্পে এখন যোগ হয়েছে আধুনিক বৈদ্যুতিক চালিত তাঁত। উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। উৎপাদিত পণ্যের মানও বেড়েছে। এসব পণ্য এখন সৌদি আরব, আমেরিকা, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে। ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার তাঁতে বোনা লুঙ্গির সুনাম দেশজুড়ে। জয়পাড়ার লুঙ্গি দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে বিদেশে। সারাদেশে লুঙ্গির যে ক’টি হাট রয়েছে, তার মধ্যে জয়পাড়ার লুঙ্গির হাট প্রসিদ্ধ। প্রায় ১০০ বছর আগে তাঁতে বোনা লুঙ্গির গোড়াপত্তন হয়েছিল এখানে। এক সময় খুবই জমজমাট ছিল দোহারের জয়পাড়া লুঙ্গির হাট। রুহিতপুরি লুঙ্গি উপমহাদেশে বিখ্যাত। তাঁতের লুঙ্গি বেলকুচি উপজেলার অন্যতম ঐতিহ্য। বিশ্ববাজারে নরসিংদীর লুঙ্গির ব্যাপক কদর ও সমাদর। সিরাজগঞ্জ সদর ও কামারখন্দ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, শুধু পাইকোশা গ্রামের ৫ থেকে ৬ হাজার পরিবার গামছা ও লুঙ্গি তৈরির পিক লুমের সঙ্গে জড়িত।
এখানে প্রায় ১০ হাজার পিক লুম ও অন্তত ১ হাজার পাওয়ার লুমের মাধ্যমে প্রতিমাসে সাড়ে ৫ লক্ষাধিক গামছা ও লুঙ্গি তৈরি করে। যার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা। কারিগরদের তৈরি এসব গামছা-লুঙ্গি সপ্তাহে দু’দিন স্থানীয় পাচলিয়া হাটে বিক্রি করে। পরে মহাজনরা সেখান থেকে গাউছিয়া ও করটিয়া হাটে নিয়ে যায়।