দ্রুত বাড়ছে হিমায়িত খাদ্যের বাজার
- উদ্যেক্তা ডেস্ক
ব্যস্ত নগরজীবনে সকাল ও বিকেলের নাশতা তৈরির ঝামেলা থেকে বাঁচতে এখন অনেক বাসাতেই প্যাকেটজাত রুটি-পরোটা ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার বাসায় অতিথি এলে বা বিকেলের নাশতা হিসেবে পুরি, শিঙাড়া, চিকেন নাগেটের মতো খাবারের চাহিদাও এখন বেশ ভালো। কারণ, এসব খাবার এখন আর দীর্ঘ সময় নিয়ে হাতে তৈরি করতে হয় না। ফ্রিজ থেকে বের করে তেলে ভাজলেই হয়ে গেল।
জীবনযাপনের পরিবর্তন ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় হিমায়িত খাবারের প্রতি মানুষের নির্ভরতা তাই ক্রমেই বাড়ছে। এসব খাদ্যপণ্য আগে বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। এখন দেশেই বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। বাজার ধরতে এসব প্রতিষ্ঠান বেশ বড় অঙ্কের বিনিয়োগও করেছে এ খাতে।
হিমায়িত খাদ্যপণ্য মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত। এগুলো হলো পরোটা, স্ন্যাকস ও মাংসের তৈরি খাদ্যপণ্য। মাংসের তৈরি খাদ্যপণ্যের বেশির ভাগই মুরগি থেকে তৈরি করা হচ্ছে। মাছের তৈরি খাবারের কিছু আইটেমও পাওয়া যায়।
বাজারে সুপারশপগুলোতে বেশি বিক্রি হয় এসব ব্র্যান্ডের হিমায়িত খাদ্য। তবে এখন ক্রেতাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় অলিগলির বড় দোকানও এসব হিমায়িত খাদ্য রাখছে। বিভিন্ন কোম্পানি এক প্যাকেট শিঙাড়া বা সমুচা সাধারণত ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বিক্রি করে। ২০টি পরোটার একটি প্যাকেট বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। চিকেন নাগেট, মিটবল, স্প্রিং রোল, চিকেন রোলের মতো আইটেমগুলো প্যাকেটের আকারভেদে বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়।
হিমায়িত খাদ্যের বাজারে এখন ১০টির বেশি কোম্পানি আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গোল্ডেন হারভেস্ট, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, কাজী ফার্মস, আইজি ফুডস, প্যারাগন, ব্র্যাক চিকেন, আফতাব ফুডস, সিপি, রিচ ফুড, এজি গ্রুপ ইত্যাদি।এসব কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সব মিলিয়ে হিমায়িত খাদ্যপণ্যের বাজারের আকার ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। তবে প্রতিবছর এ বাজার গড়ে ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিছু কিছু কোম্পানির বিক্রি বাড়ছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হারে।
দেশে ২০০৬ সাল থেকে হিমায়িত খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে গোল্ডেন হারভেস্ট। এদের হিমায়িত খাদ্যপণ্যের মধ্যে রয়েছে পরোটা, আলু ও ডালপুরি, বিফ ও চিকেন স্প্রিং রোল, শিঙাড়া, সমুচা, চিকেন নাগেটসসহ মুরগির মাংসের তৈরি নানা পদ। এ ছাড়া চিকেন মিটবল, মিষ্টি ও ঝাল স্বাদের চিকেন উইংস, পপ চিকেন, চিকেন স্ট্রিপস নামের নতুন কয়েকটি পণ্য সম্প্রতি বাজারে এনেছে তারা।
এসব খাদ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য গোল্ডেন হারভেস্টের ১৬টি পণ্য উৎপাদন লাইন আছে। আর উৎপাদিত পণ্য মজুত রাখার জন্য রয়েছে ৩৭টি ইউনিট। কোম্পানিটির গ্রুপ ব্র্যান্ড ম্যানেজার ফারহান হাদি বলেন, মানুষের ব্যস্ত জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে এখন অনেকেই তৈরি হিমায়িত খাদ্যের প্রতি ঝুঁকছেন। মানুষের নতুন এ চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই গোল্ডেন হারভেস্ট গত কয়েক বছরে ঢাকা ছাড়াও দেশের সব বড় শহরে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ হিমায়িত খাদ্যের বাজারে এসেছে ২০১৩ সালে। প্রতিষ্ঠানটির হিমায়িত খাদ্যের ব্র্যান্ড-নাম ‘ঝটপট’। এ ব্র্যান্ডে তারা পরোটা, শিঙাড়া, সমুচা, রুটি, চিকেন স্প্রিং রোল, চিকেন নাগেট, চিকেন পেটি, চিকেন সসেজ, অনথন, পুরি, পপকর্নসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। দেশের পাশাপাশি কয়েকটি দেশে এসব খাদ্যপণ্য রপ্তানিও করছে প্রাণ-আরএফএল।
কাজী ফুডস ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৪ সালে দেশের বাজারে হিমায়িত খাদ্যপণ্যের ব্যবসা শুরু করে। নিজস্ব খামারে উৎপাদিত মুরগির তৈরি বিভিন্ন আইটেমের পাশাপাশি টিজার্স, স্ট্রিপস, স্প্রিং রোল, নাগেটস, পরোটা, পুরি, সমুচা হালকা খাবারও বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের কাজী ফার্মস কিচেন আউটলেট নামের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র আছে। পাশাপাশি সুপারশপ ও সাধারণ মুদিদোকানে তাদের পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
ভালো মানের কারণে খুব অল্প সময়ে বাজারে তাদের পণ্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে উল্লেখ করে কাজী ফুডসের ফ্র্যাঞ্চাইজি অপারেশন বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের খামারে মুরগিকে সবজিভিত্তিক (ভেজিটেবল বেসড) খাবার খাওয়ানো হয়। যাতে সর্বোচ্চ মানের মাংস উৎপাদন করা যায়। উৎপাদিত পণ্যে টেস্টিং সল্ট, নাইট্রেটের মতো কোনো প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় না। এসব কারণেই কাজী ফুডসের পণ্য ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছে।’
ইসলাম গ্রুপের আইজি ফুডস লিমিটেড রেডি শেফ ব্র্যান্ডের নামে হিমায়িত খাদ্যপণ্য সম্প্রতি বাজারে নিয়ে এসেছে। এই ব্র্যান্ডের মুরগির তৈরি চার রকমের পণ্য আছে প্রতিষ্ঠানটির। এর মধ্যে ফ্রাইড চিকেন, উইংস, নাগেট, মিটবল, ড্রামস্টিকের মতো মুরগি থেকে প্রস্তুত খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব খামারে উৎপাদিত হিমায়িত ব্রয়লার মুরগির মাংস বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
শুধু মুরগির মাংসের তৈরি বিভিন্ন হিমায়িত খাদ্যপণ্য ফ্র্যাঞ্চাইজি বা অনুমোদিত বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রি করে সিপি। সিপির তৈরি চিকেন বল, ফ্রাইড চিকেন, চিকেন ললিপপ, চিকেন পেটি, চিলি নাগেটস ও রেগুলার নাগেটস বেশ জনপ্রিয় বাজারে। ঢাকার অনেক পাড়া-মহল্লায় সিপির ফ্র্যাঞ্চাইজিতে এসব খাবার ভেজে বিক্রি করা হয়। সর্বনিম্ন ২০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকার মধ্যে সিপির এসব খাদ্যপণ্য কিনতে পাওয়া যায়। এ বছর ৪০টি আইটেমের হিমায়িত খাদ্যপণ্য নিয়ে বাজারে এসেছে প্যারাগন গ্রুপ। এর মধ্যে মুরগির তৈরি চিকেন আইটেম আছে ২৫টি। আর পরোটা, সমুচা, শিঙাড়া, চিকেন রোল, ভেজিটেবল রোলসহ ১৫ রকমের স্ন্যাকস আইটেম বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা, চট্টগ্রামের বিভিন্ন সুপারশপ ও বড় দোকানে পাওয়া গেলেও শিগগির অন্য শহরে পণ্য বাজারজাত করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বেচাকেনা পাঁচ কোটিতে উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করেছে বলে জানা গেল।
হিমায়িত খাদ্যের বাজারে সম্ভাবনার পাশাপাশি এ খাতের কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও জানালেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, হিমায়িত খাদ্যপণ্যকে সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য খুচরা বিক্রেতা পর্যায় পর্যন্ত সরবরাহের ব্যবস্থা (কোল্ড চেইন) ঠিক রাখতে হয়। সরবরাহের ব্যবস্থা ঠিক রেখে সর্বোচ্চ মানের পণ্য ক্রেতার হাতে তুলে দিতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।এ ধরনের হিমায়িত খাদ্য মূলত শিশু, কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা পছন্দ করেন। তাঁদের আগ্রহের কারণে পরিবারে অভিভাবকদের সেগুলো কিনতে হয়। আবার যাঁদের সকাল-বিকেল নাশতা বানানোর সময় নেই, তাঁদের কাছে এসব খাবার খুবই জনপ্রিয়। বাচ্চাদের স্কুলের টিফিন হিসেবেও এসব পণ্য জনপ্রিয়।
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা উম্মে সালমা বলেন, ছোটরা এসব খাবার খেতে চায়। কিন্তু রাস্তার পাশের খাবার স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সেগুলো পোড়া তেলে ভাজা হয়। দোকান থেকে কিনে এনে বাসায় ভেজে খাওয়ালে সে ঝুঁকি নেই।