শিম চাষে বদলে যাচ্ছে ঈশ্বরদীর অর্থনীতি

শিম চাষে বদলে যাচ্ছে ঈশ্বরদীর অর্থনীতি

  • উদ্যেক্তা ডেস্ক

ফসলের মাঠ ও সবজির আড়তে একসময় দিনমজুরিতে কাজ করতেন পাবনার ঈশ্বরদীর মুলাডুলি গ্রামের আবদুল হামিদ। কিন্তু অভাবের সংসারে দিনমজুরির আয়ে চলত না। কষ্ট লেগেই থাকত। ইতিমধ্যে এলাকার অনেককে শিমের চাষ করে ভালো আয় করতে দেখে তিনিও অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে নেমে গেলেন এই সবজির আবাদে। বদৌলতে বছর দশেকের মধ্যে বেশ সচ্ছল হয়ে ওঠেন তিনি। নগদ ১০ লাখ টাকার পুঁজিতে সবজির আড়ত গড়ে তোলার পাশাপাশি বাড়িতেও তৈরি করেছেন দালান।

একইভাবে মুলাডুলি স্টেশনপাড়ার কৃষক নজরুল ইসলামও এক যুগ আগে জমি বর্গা নিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে শিম চাষ শুরু করেন। এত দিনে তাঁর ভাগ্য বদলে গেছে, সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল সবই হয়েছে। যেখানে ছিল পুরোনো টিন ও খড়ের ঘর, সেখানে তৈরি করেছেন তিনতলা পাকা বাড়ি।

শিম চাষে শুধু নজরুল কিংবা হামিদই নন, গোটা মুলাডুলি গ্রামের শত শত মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। একসময় পিছিয়ে থাকা এই গ্রামটিতে কোথাও এখন আর খড়ের বা কাঁচা কোনো ঘর নেই। গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়ে চকচকে টিনের ঘর আর ঝকঝকে পাকা দালান। পরিবর্তন এসেছে সবার জীবনযাত্রায়। সবচেয়ে ভালো খবর হলো লেখাপড়া ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা।

শিম চাষকে ঘিরে মুলাডুলিতে গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গের একটি বৃহৎ সবজির আড়ত ও দৈনিক বাজার। ব্যবসায়ী-আড়তদারেরা জানান, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগর চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী প্রভৃতি জেলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই মোকাম থেকে ট্রাক বোঝাই করে শিম কিনে নিয়ে যান।

মুলাডুলি সবজিবাজার ও আড়তদার সমবায় সমিতির অর্থ সম্পাদক আমিনুর রহমান ওরফে শিম বাবু জানান, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত শিমের ভরা মৌসুম থাকে। এ সময় শুধু মুলাডুলি নয়, পাবনার আটঘরিয়া, কাশীনাথপুর, নাটোরের বড়াইগ্রাম, রাজাপুর, গুরুদাসপুর, লালপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার চাষিরাও এখানে শিম বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। সব মিলিয়ে মুলাডুলি থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৭০ থেকে ৮০ ট্রাক শিম নেওয়া হয়। এই শিমের দাম এক কোটি টাকার মতো।

কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, ঈশ্বরদী উপজেলায় প্রতিবছর ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকার শিম বেচাকেনা হয়। এর অধিকাংশই হয় মুলাডুলিতে। তবে মুলাডুলির কৃষকদের দাবি, শুধু তাঁরাই মৌসুমে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার শিম বিক্রি করেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, মুলাডুলি মোকামে আগাম জাতের শিম উঠতে শুরু করেছে। প্রতি কেজি শিম ১০০ টাকা বা তার কিছু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সেখানে কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার আড়তদার জসিম উদ্দিন জানান, শিমের মৌসুম শুরু হলেই তাঁরা ২৫-৩০ জন পাইকারি ব্যবসায়ী দল বেঁধে মুলাডুলিতে চলে আসেন। কিশোরগঞ্জে ব্যাপক চাহিদা থাকায় তাঁরা মুলাডুলি থেকে নিয়মিত পাইকারি দরে শিম কিনে নিয়ে যান।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মুলাডুলি গ্রামের কৃষকেরা ‘নিজেদের উদ্ভাবিত’ নতুন পদ্ধতিতে শিম চাষ করেন। এটি ইতিমধ্যে ‘মুলাডুলি শিম চাষ’ পদ্ধতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশের আরও কয়েকটি জেলার কৃষকেরা এখন শিম চাষে লাভবান হচ্ছেন। এমনকি বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষি বিভাগের কর্মীরাও সরেজমিনে ‘মুলাডুলি শিম চাষ পদ্ধতি’ দেখতে আসেন।

স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারাও মুলাডুলির শিম চাষ পদ্ধতিকে দেশের কৃষি খাতের জন্য একটি মডেল মনে করেন। কারণ, মুলাডুলিতে প্রায় তিন দশক ধরে একটি কার্যকর পদ্ধতিতে শিমের চাষ হয়ে আসছে। মুলাডুলির প্রবীণ কৃষকেরা জানান, আগে শিম চাষ হতো মূলত বাড়ির আঙিনায়। কিন্তু ২৭-২৮ বছর ধরে নিজেদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে ফসলের মাঠেই চাষ হচ্ছে শিমের। এ পদ্ধতিতে কৃষকেরা জমিতে মাটি উঁচু (ঢিবি) করে শিমের আবাদ করেন, যাতে পানি না জমে। কারণ, শিমের জমিতে পানি জমলে গাছ মরে যায়। শিমের গাছগুলো বেড়ে ওঠার জন্য তৈরি করা হয় জাংলা। গাছে যখন শিম ধরে তখন তা এই জাংলাতেই ঝুলে থাকে।

প্রবীণ শিমচাষি শফিকুর রহমান বলেন, ১৯৮৮ সালের দিকে এলাকার আবদুল খালেকসহ কয়েকজন কৃষক প্রথম এই পদ্ধতিতে শিমের আবাদ শুরু করেন। তাতে ভালো ফলন হওয়ায় পরের বছর থেকেই এ পদ্ধতিতে, অর্থাৎ জমিতে ঢিবি তৈরি করে শিমের চাষ করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। এভাবে এক এক করে গ্রামের অন্য কৃষকেরাও শিমচাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। পরবর্তী সময়ে এ পদ্ধতিতে শিম চাষ অন্যান্য জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ে।

মুলাডুলি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সেলিম মালিথা বলেন, শিম চাষের কারণে মুলাডুলির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বর্তমানে এখানকার ৯৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিম চাষের সঙ্গে জড়িত। শিম চাষ করে লাভবান হয়ে উঠছেন কৃষকেরা। গ্রামের চেহারা বদলে গেছে। গ্রামে খড় ও টিনের ঘরের পরিবর্তে ইট-সিমেন্টের নতুন বাড়িঘর তৈরি হয়েছে।

সেলিম মালিথা আরও বলেন, মুলাডুলিতে মানুষ আর বেকার নেই। নারী-পুরুষ সবাই মিলে শিম চাষে নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া শিমের জমিতে ফুল বাছাই ও পরিচর্যার কাজ করেন প্রচুরসংখ্যক দিনমজুর। তাঁরা প্রত্যেকে প্রতিদিন (মৌসুমে) ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মতো আয় করেন।

কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, মুলাডুলিতে তিন জাতের শিম উৎপাদন হয়। এগুলো হচ্ছে রূপবান, অটো ও ঘৃতকাঞ্চন শিম। এর মধ্যে অটো শিমের আবাদ শুরু হয়েছে তিন বছর আগে থেকে।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, গোটা মুলাডুলি ইউনিয়নে এখন শিম চাষির সংখ্যা ৪ হাজার ৬০০। প্রতিবছর এখানে শিমের আবাদ বাড়ছে। যেমন এ বছর ঈশ্বরদীতে ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে শিমের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মুলাডুলিতেই হয়েছে ১ হাজার ২০০ হেক্টরে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রওশন জামাল জানান, মুলাডুলি বর্তমানে শিম চাষের একটি মডেল গ্রাম। কারণ, শিমের আবাদ এখানকার কৃষকদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এতে তাঁদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, মুলাডুলি শিম চাষপদ্ধতি অনুসরণ করে দেশের অন্যান্য জেলার কৃষকেরাও এখন স্বাবলম্বী হচ্ছেন। বর্তমানে এটি খুবই লাভজনক ও উচ্চমূল্যের সবজি। ধানের তুলনায় দাম বেশি হওয়ায় কৃষকেরা এই শিম চাষে ঝুঁকে পড়ছেন।

সূত্র: প্রথম আলোfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment