ফিরে আসছে মসলিন
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
ভোরের বাতাসে আর্দ্রতা খুঁজতে কুমারী মেয়ে নৌকা ভাসিয়ে চলে যেত নদীর মাঝখানে। শঙ্খ বা কচ্ছপের ডিমের ওপর আড়াআড়িভাবে হাত রেখে নরম আঙুল ঘুরিয়ে তারা সুতা কাটত। আর সেই সুতায় তৈরি হতো অতি মসৃণ ও মিহি এক ধরনের কাপড়। ৫০ মিটার দীর্ঘ সে কাপড় অনায়াসে একটি দিয়াশলাইয়ের বাক্সে ভরে রাখা যেত। আর তা কিনে নিয়ে যেত পৃথিবীর ধনাঢ্য রাজা-বাদশাহরা তাদের মহারানীদের মন জয় করতে।
মসলিন, বাংলার ইতিহাসের সেই বিখ্যাত কাপড়ের নাম। মসলিন শুধু একটি নাম নয়, একটি কিংবদন্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজসিক আভিজাত্যের সাক্ষী। এটি আপন মহিমায় সৌন্দর্য ও শিল্প নৈপুণ্যে অনবদ্য। কালের বিবর্তনে সেটি হারিয়ে গেলেও নতুনভাবে তা ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে পরিদর্শনে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় তিনি ঐতিহ্যের মসলিন বস্ত্রের সুতা তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেন।
ওই নির্দেশের আলোকে মসলিন ফিরিয়ে আনতে সাড়ে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্যের মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার’। প্রকল্পের মেয়াদ হচ্ছে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। ব্রিটিশ শাসনামলে কলকারখানা থেকে সাশ্রয়ী কাপড় আসায় একসময় হারিয়ে যায় দীর্ঘ সময় নিয়ে মসলিন তৈরির তাঁত ও সুতা। সেই সুতা ফিরিয়ে আনা হবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
সূত্র আরও জানায়, গত ২৬ সেপ্টেম্বর এ প্রকল্পের অধীনে জনবল নিয়োগের জন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি মসলিন কাপড় ফিরিয়ে আনতে ইতিমধ্যে ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে গবেষণা খাতে। গবেষণার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. মনজুর হোসেনকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিও মসলিন পুনরুদ্ধারে কাজ করবে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মিহি সুতায় বোনা সূক্ষ্ম যে কাপড়ের দুনিয়াজোড়া খ্যাতির কথা আজকের বাঙালি জেনেছে ইতিহাসের পাতা থেকে, সেই মসলিন আবার ঢাকায় ফিরছে!
গবেষকরা বলছেন, আড়াইশ কাউন্টের চেয়ে মিহি সাদা সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হতো শত বছর আগে। রাজ পরিবারের মেয়েদের পছন্দের শীর্ষে থাকা এ শাড়ি বোনা হতো কার্পাসের সুতায়। এ জন্য এক সময় বৃহত্তর ঢাকার মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীর সংলগ্ন অঞ্চলে হতো ফুটি কার্পাসের চাষ। সেই সুতা তৈরি হতো নদীতে নৌকায় বসে, উপযোগী আর্দ্র পরিবেশে। পুরো একটি মসলিন একটি ম্যাচের বাক্সে ভরতে পারার যে কথা প্রচলিত আছে সেটা ৮০০ কাউন্টের সুতায় বোনা। ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১২০০ কাউন্টের সুতার মসলিন ‘জঙ্গলবাড়ির’ কাছে কিশোরগঞ্জের একটি গ্রামে সেটা বানিয়েছিল। ওইখানে ১২০০ কাউন্ট কী কোনো তাঁতই নেই আজ। ১৮৬২ সালেও এটা ছিল।
গবেষকদের মতে, ‘মসলিন নানা ধরনের ছিল। একটি ধরন ছিল জামদানি, যেটা ফুলওয়ালা। আরেকটা ছিল মসৃণ। আরেকটি ধরন ছিল ডুরিয়া, যেটাতে দাগ আছে। আরেকটি ধরনের রং ছিল। সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ ধরনের মসলিন ছিল।’
প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের সুখ্যাতি থাকলেও মূলত মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন থেকেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সম্রাট, নবাবেরা মসলিন কাপড় কেনা আরম্ভ করেন চড়া দামে। সে যুগে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর। জঙ্গলবাড়ি অধিকাংশের পেশা তখন মসলিন বোনা। উনিশ শতকের প্রথমভাগেও সেখানে এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় ১০০ তাঁতি পরিবার। জঙ্গলবাড়ি থেকে মাইল কুড়ি দূরে বাজিতপুর- ওখানে জন্মাত উঁচুমানের কার্পাস, যা থেকে তৈরি হতো উঁচুমানের মসলিন। আজ থেকে ২০০ বছর আগেও বিদেশী বণিকরা সোনারগাঁ থেকে মসলিন বিদেশে রফতানি করত। ওখানকার প্রায় দেড়হাজার তাঁতি সে সময় মসলিন বুনে সরবরাহ করত ইংরেজ কোম্পানিকে। জেমস টেলর সাহেব ১৮৫১ সালে যখন মসলিনের ওপর একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন মসলিনের স্বর্ণযুগ তখন পড়তির দিকে; অথচ যা জানা যায় ঢাকাতে তখনও সাতশ ঘরের বেশি তাঁতি নিয়োজিত ছিল এ কাজে।
জানা গেছে, এক সময় বাংলাদেশ থেকে রফতানির জন্য কেনা হয়েছিল প্রায় ঊনত্রিশ কোটি টাকার মসলিন। ১৭৭২ সালের এক হিসাব থেকে দেখা যায় ওই বছর সম্রাটকে পাঠানো হয় এক লাখ টাকার ‘মলবুস খাস’ আর বাংলার নবাবকে পাঠানো হয় তিনলাখ টাকার ‘সরকার-ই-আলি’। ওলোন্দাজ ব্যবসায়ীরা ইউরোপে ১৭৮৭ সালে এক লাখ টাকার মসলিন রফতানি করে। ইংরেজ কোম্পানি ওই বছর সংগ্রহ করে তিন লাখ টাকার মসলিন। এ ছাড়া ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা যখন বাংলার বর্তা হয়ে ওঠে তখন তারা বছরে আট লাখ টাকার মসলিন রফতানি করত। সে সময়ে ফরাসিরা কিনেছিল প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন। এরা ছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশী ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে ব্যবসা করতেন।