আজ জুমের দিন
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
চামেলী দেবী ত্রিপুরা। বয়স ৪৫ ছোঁয় ছোঁয়। স্বামীর নাম সুনীল জীবন ত্রিপুরা। তিন মেয়ে এক ছেলে তাঁদের। সংসারে শাশুড়ি আছেন। শ্বশুরও ছিলেন, মারা গেছেন গেল বছর। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়ায়। মেজো মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে আর ছোটটি তৃতীয় শ্রেণিতে। ছেলেটা পড়ছে কলেজে। বউ হয়ে ১৮ বছর বয়সে এ সংসারে এসেছেন চামেলী। তাঁর বাপের বাড়ি চেলাছড়া পাড়ায়। শ্বশুরবাড়ি আলুটিলা পুনর্বাসন গ্রামে। জুম চাষ করেই চলে চামেলীর সংসার। ২৫ বছর হয় পাহাড়ে পাহাড়ে জুম চাষ করে চলেছেন। বাপের বাড়ির লোকেরা জুম চাষ করেন না। বাপের সমতলে চাষের জমি আছে। স্বামীর ঘরে এসে শুরু হয় তাঁর জুমের জীবন। ধান কাটতে কাটতে বলে চলেন জুমের গল্প।
জুমজীবনের শুরু
বউ হয়ে আসার পর শ্বশুর-শাশুড়ির পিছু নিতেন। উঁচু-নিচু পাহাড়-ছড়া ডিঙিয়ে হাঁপিয়ে উঠতেন। শেষে পথ গিয়ে শেষ হতো জুমের ক্ষেতে। শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাদেখি কাজ করতেন। জুম চাষই ছিল শ্বশুরবাড়ির ভরসা। পুরোটা রপ্ত করতে বেশ সময় লেগেছে চামেলীর। কারণ এর নিয়মকানুন অনেক।
নিজে দায়িত্ব নিলেন
নিজেদের আলাদা সংসার হওয়ার পর দায়িত্ব বুঝে নিতে হলো চামেলীকে। শ্বশুর-শাশুড়ি দিয়েছিলেন তিন কেজি গেলং জাতের ধান। স্বামীর পকেটে ছিল ৫০০ টাকা। ঘরে ছিল হাতে বোনা একটা শাল। একটা দা রাখা ছিল মাচানের ওপর। তা-ই সম্বল করে পৌঁছে গেলেন জুমের ক্ষেতে। বন থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বাঁশ আর শণ। তৈরি করেছিলেন ছোট্ট একটি টংঘর। তখন ছিল মাঘ মাস। ওই মাসেই শুরু করতে হয় জুমের কাজ। সবাই তখন যার যার জুম পাহাড়ে ঝোপঝাড়, লতাপাতা, গাছপালা কাটে। তারপর তিন মাস খালি ফেলে রেখে শুকাতে হয়। তিন মাস পর আগুন দিয়ে পোড়াতে হয়।
সঙ্গী ছিল স্বামী
ছেলেমেয়েরা তখন সব ছোট ছোট। স্বামীই ছিল চামেলীর সঙ্গী। আরো কয়েকজন মজুর জোগাড় করে নিতেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে জুমঘরে অনেক দিন ধরে থাকতেন তাঁরা। এরপর একসময় চামেলী যখন চাষের পুরোটা সামলে উঠতে পারছিলেন, তখন স্বামী বাজারের দিকটাই বেশি খেয়াল রাখতেন। আরো পরে অবশ্য ছেলেমেয়েরাও সঙ্গী হয়েছিল।
জুমের বৈশাখ
বীজ বপন করতে হয় বৈশাখ এলে। প্রথমে লাগান হলুদ। তার সপ্তাখানেক পর ধান। তারপর কলা, মরিচ, মারফা, তিল, কাউন চাল, শিম, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, ঝিংগা, চিচিঙ্গা, জুম বেগুন ইত্যাদি। হলুদের আবার কয়েকটি জাত হয় যেমন—দেশি, পাবনা, বাতয়াথিক, মইংচইং চানাই ইত্যাদি। ধানেরও কয়েকটি যেমন—মালতি, কম্পানি, সালুমা, গেলং, মাইগিরা, মাইমি প্রভৃতি জাত। মাইমিটা হলো বিনি ধান। বিনি চালের ভাত সুগন্ধ ছড়ায়। চামেলী ত্রিপুরা প্রথম যে বছর জুম চাষ শুরু করেছিলেন, তখন অনেক ধান ঘরে তুলেছিলেন। ফসল ভালো হয়েছিল সে বছর। প্রায় সারা বছরের খোরাকি জমে গিয়েছিল ঘরে। অর্থাৎ চাল কিনতে হয়নি। তবে কোনো কোনো বছর এমনও হয় যে তিন মাসের খোরাকিও তৈরি হয় না। দুই হাটের বেশি সবজি বিক্রি করা যায় না। ওই বছর সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়ে যায়।
জুমের হাট
চামেলীর পরিবারে ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল তখন তাঁর স্বামী হাটে যেতেন ফসল বিক্রি করতে। হাট থেকে পুরো সপ্তাহের প্রয়োজনীয় বাজার করে আনতেন। তখন চামেলী বাচ্চাদের দেখাশোনা করতেন। মাঘ থেকে চৈত্র—এই তিন মাস একটু বেশি কষ্ট করে চলতে হয়। যাদের ভালো জুম হয়, তাদের খোরাকি থাকে। চামেলীর শ্বশুর মারা যাওয়ার আগে অনেক দিন ভুগেছেন। তাই শ্বশুরের শুশ্রূষায় সময় দিতে হয়েছে। জুমের দেখভাল ঠিকমতো করতে পারেননি। ক্ষতি হয়ে গেছে বেশ। বানর, টিয়া, কাঠবিড়ালী জুমক্ষেতের ফসল খেয়ে গেছে। পাহারা দিতে পারেননি। ওদিকে আবার জুম চাষের জমিও ক্রমেই কমে যাচ্ছে। একই পাহাড়ে বারবার চাষ দিতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
সার আর কীটনাশকও লাগছে জুমে
বারবার একই জমিতে চাষ দেওয়ায় জমি উর্বরতা হারিয়ে ফেলছে। এখন রাসায়নিক সার আর কীটনাশক প্রয়োগ না করলে ফসল ঘরে তোলা যাচ্ছে না। আগে যেনতেনভাবে বীজ মাটিতে ফেললেও ফসল মিলত। এক বছর তো পাঁচ একর জায়গায় ৪০০ আড়ি (১ আড়ি প্রায় ১০ কেজি) ধান ঘরে তুলেছিলেন চামেলী। সে রকম দিন এখন স্বপ্নের মতো লাগে।
এবার পাঁচ একর
পাহাড়ের ঢালে এবার চামেলী ও তাঁর পরিবার পাঁচ একরের মতো জায়গায় জুম চাষ করেছেন। মাঘ মাসের শুরুতে সবাই মিলে ঝোপঝাড়, লতাপাতা, গাছগাছালি কেটেছেন। তিন মাস পর লতাপাতা আগুন দিয়ে পুড়িয়েছেন। এর ফলে যে ছাই পাওয়া যায়, তা জমির উর্বরতা বাড়ায়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ বীজ রোপণের সময়ও পরিবারের সবাই হাত লাগিয়েছেন। প্রথমে পাবনা জাতের হলুদের বীজ দিয়েছেন। সপ্তাখানেক পর ধান দেওয়া হলো। সঙ্গে অন্যান্য ফসলের বীজ যেমন—মারফা, চাল কুমড়া, কাউন চাল, ঢেঁড়শ, টিটা করলা আর কলা লাগিয়েছেন। জুমে ফসল লাগাতে হয় হিসাব করে ধাপে ধাপে।
আষাঢ়-শ্রাবণের অপেক্ষা
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেন জুমচাষিরা। গাছগুলো তবেই না বেড়ে ওঠে। পরের তিন-চার মাস কাজ বলতে টিয়া-কাঠবিড়ালী তাড়ানো আর মাঝেমধ্যে আগাছা পরিষ্কার করা। না হলে আগাছা বড় হয়ে গাছ ঢেকে দেয়। প্রয়োজনে কীটনাশকও দিতে হয়।
ভাদ্র এলে
জুমচাষির প্রথম পর্যায়ের অপেক্ষা ফুরায় ভাদ্র এলে। নতুন ফসলের বারতা নিয়ে আসে ভাদ্র। জুমের গেলং জাতের ধানে পাক ধরে। গাছে মারফাও (শসা ধরনের ফসল) ধরা শুরু হয়। ফসল সংগ্রহের আগে চামেলীরা ধন দেবীকে পূজা দেন। গ্রামের এক বৈদ্যকে ডেকে আনা হয় মন্ত্রপাঠের জন্য। যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় এ প্রথা চলে আসছে। এই বছর ধন দেবীকে একটি হাঁস বলি দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন চামেলী। জুমিয়াদের বিশ্বাস, ধন দেবী সন্তুষ্ট থাকলে ঘরে ধান তোলায় সমস্যা হয় না।
ভোজ হবে
পাকা ধান সুবাস ছড়ায় ঘরের আঙিনায়। চামেলীর মনে আনন্দ ঢেউ তোলে। সে ধান ঘরে তোলার পর আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য একটি ভোজের আয়োজন করবেন চামেলী। খুশি হয়েই কাজটা করে থাকেন চামেলী। উল্টো দিকে পাড়ার অন্য পরিবারগুলোর ভোজেও দাওয়াত পায় চামেলীর পরিবারের সবাই। এই প্রথাও চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। চামেলী এখনো সব ধান কেটে শেষ করতে পারেননি। তবে মারফা তোলা হয়ে গেছে। অগ্রহায়ণে তিল পাকতে শুরু করবে। তারপর ধাপে ধাপে হলুদ ও কলা তোলা হবে। হলুদের জন্য কষ্ট একটু বেশি করতে হয়। কারণ কাঁচা হলুদ সিদ্ধ করে তারপর রোদে শুকাতে হয়। তারপর শুকনো হলুদ সংরক্ষণেরও নানা কায়দা আছে। এত ঝক্কি-ঝামেলাও সয়ে নেন চামেলী। কারণ হলুদ বিক্রি হলে তাঁদের অবস্থা ফেরে। সাবান-স্নোর মতো দু-একটা শৌখিন জিনিস ছেলেমেয়েদের কিনে দিতে পারেন। এভাবেই আবার মাঘ মাস চলে আসে। শুরু হয় নতুন জুমের কাজ।