কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে তৈরি পোশাক
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের দেশভিত্তিক সর্ববৃহৎ একক বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রাধিকারমূলক রফতানি সুবিধা (জিএসপি) হারিয়ে আহত হয়েছেন রফতানিকারকরা আরও আগেই। অঞ্চলভিত্তিক সর্ববৃহৎ বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ইংল্যান্ডের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণায় তারা হন মর্মাহত।
গ্যাস-বিদ্যুতের সীমাহীন দুর্ভোগ তো এ দেশের উদ্যোক্তাদের নিত্যসঙ্গী। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ১২ জাতির জোট ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপে (টিপিপি) অন্যতম প্রতিদ্বন্দ¦ী ভিয়েতনামের অন্তর্ভুক্তি নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশকে। একের পর এক বিদেশী হত্যাকা- এবং উগ্রবাদী হামলার ঘটনায় বায়ারদের ফিরে যাওয়ার প্রবণতা তো আছেই। চ্যালেঞ্জের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বাজার দখলে প্রতিযোগী ভারতের আগ্রাসী কর্মসূচী। পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে নতুন করে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার।
তৈরি পোশাক শিল্প খাত সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল ও ভারতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক বাজার দখলের কৌশলে বাংলাদেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ৭০ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বিক্রি হয়। বছরে রফতানির তিন বিলিয়ন ডলারের বেশিরভাগই পোশাক খাতের। ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্রিটেনের বাজারে বাংলাদেশী পোশাক শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। ভারত সরকার পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ঘোষণা করেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের মধ্যে তারা চার হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সম্ভাব্য হুমকি ও চ্যালেঞ্জসমূহ যথাযথভাবে মোকাবেলা করা না গেলে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিভিন্ন পর্যায়ের রফতানিকারকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতে প্রথম বড় ধাক্কা লাগে ২০১৩ রানা প্লাজা ধসের ঘটনায়। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার (জিএসপি) হারানোর ঘটনায় আরেক দফা মুষড়ে পড়েন এ খাতের উদ্যোক্তারা। সুশাসন ও মানবাধিকারসহ নানা বিতর্কের জেরে নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশ থেকে ইংল্যান্ডে কার্গো পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়া, একের পর এক বিদেশী হত্যাকা-ে বায়ারদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়া, ধারাবাহিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তায় উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি এবং সর্বোপরি তীব্র গ্যাস-বিদ্যুত সঙ্কটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শত শত কারখানা। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছেন রফতানি আয়ে ৮৩ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী তৈরি পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কের ক্রমাবনতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কিছুদিন পরপরই বিদেশী দূতাবাসগুলোর উপর্যুপরি রেড এ্যালার্ট জারির ঘটনায় তৈরি পোশাক শিল্প খাতের ক্রেতাদের আনাগোনা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের দখল ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে ভারতীয়দের হাতে। অন্য দিকে বিদ্যুত ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে প্রতি ডজন পোশাকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে গড়ে ৯৫ সেন্ট। অথচ বাড়ানোর পরিবর্তে বায়াররা প্রতিনিয়ত কমিয়ে দিচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের দাম। সব মিলিয়ে যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সামনে চ্যালেঞ্জ ক্রমেই বাড়ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকার এ খাতের প্রসারে লাতিন আমেরিকা, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করছে। এমন সময়ে গুলশানে উগ্রবাদী হামলার ফলে বায়ারদের বাংলাদেশে আসতে নিরাপত্তাহীনতাবোধের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বাজার ও ব্যবসা সম্প্রসারণের কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পোশাক কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বিদেশী টেকনিশিয়ানরা স্থাপন ও মেরামত করেন উল্লেখ করে এতে আরও বলা হয়, কারখানায় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে বিদেশী টেকনিশিয়ানরা নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আসতে গড়িমসি করতে পারেন। এতে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যাহত হয়ে পণ্যের ডেলিভারি দিতে সমস্যা হতে পারে। এসব চ্যালেঞ্জ ও হুমকি মোকাবেলা করতে না পারলে পোশাক রফতানি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।