চা উৎপাদনে দেশীয়রাই ভালো করছে
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
চা শিল্পে শতভাগ বিদেশী মালিকানার জেমস ফিনলের সব বাগান এখন পরিচালনা করছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। দেশীয় মালিকানায় আসার পর ফিনলের বাগানগুলোয় চা উৎপাদন বেড়েছে ৭ শতাংশ। একই সঙ্গে বেড়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট টি কোম্পানি, কাদেরপুর টি কোম্পানি ও ব্র্যাকের বাগানগুলোর উৎপাদনও। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চা উৎপাদনে ভালো করলেও পিছিয়ে পড়ছে বহুজাতিক ডানকান ব্রাদার্স। চা উৎপাদনের চেয়ে অন্যান্য ব্যবসায় বেশি মনোযোগী হওয়ায় কমে আসছে তাদের বাগানের সংখ্যাও। যদিও একসময় দেশে উৎপাদিত চায়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসত ডানকানের বাগান থেকে।
স্কটিশ চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জেমস ফিনলে। শতবছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চা উৎপাদন করে আসছিল বহুজাতিক কোম্পানিটি। ২০০০ সালের দিকে সব বাগান বিক্রি করে দেয় তারা। চট্টগ্রামের পেডরোলো গ্রুপ, ইস্পাহানি গ্রুপ ও ফিনলে গ্রুপ বাগানগুলো কিনে নেয়। বিদেশী মালিকানায় রুগ্ণ থাকলেও দেশীয় বড় গ্রুপের অধীনে এসে দেশের শীর্ষস্থানীয় চা উৎপাদকে পরিণত হয়েছে জেমস ফিনলের বাগানগুলো।
বাংলাদেশ টি বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ফিনলের বাগানগুলোয় চা উৎপাদন হয় ১ কোটি ২১ লাখ কেজি। ৭ শতাংশ বেড়ে ২০১৫ সালে তা দাঁড়ায় ১ কোটি ৩০ লাখ কেজিতে।
১৯৯৫ সালের দিকে নিজেদের মালিকানায় থাকা ছয়টি বাগান বিক্রি করে চলে যায় শ’ওয়ালেস। চট্টগ্রামের প্যাসিফিক গ্রুপ চারটি ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানি দুটি বাগান কিনে নেয়। বর্তমানে এসব বাগানের চা উৎপাদন আগের চেয়ে বেড়েছে। এছাড়া চা উৎপাদনে ভালো করছে পেডরোলো গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ, ম্যাগনোলিয়া, কাদেরপুর টি কোম্পানি ও টি কে গ্রুপ। এক দশক আগে চট্টগ্রামভিত্তিক রামগড় ও হালদা ভ্যালির দুটি চা বাগান কিনে উৎপাদনে যায় পেডরোলো। বর্তমানে গ্রুপটির মালিকানাধীন দুটি বাগান হেক্টরপ্রতি উৎপাদনে দেশের অন্যান্য বাগানকে ছাড়িয়ে গেছে।
জানতে চাইলে পেডরোলো গ্রুপের চেয়ারম্যান নাদের খান বণিক বার্তাকে বলেন, চা বাগান ছিল একসময় শৌখিন একটি ব্যবসা। বিদেশী বাগানগুলোর মালিকানায় বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হয়েছে। ফিনলেসহ অন্যান্য বিদেশী বাগানের নতুন মালিকরা বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগে আগ্রহী নন। তবে দেশে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় উদ্যোক্তারা চা বাগান থেকে মুনাফা তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। চলতি বছর ফিনলের বাগানগুলোয় চা উৎপাদন দেড় কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চায়ের চাহিদা বৃদ্ধিকে পুঁজি করে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করায় দেশীয় উদ্যোক্তারা চা শিল্পে তুলনামূলক ভালো করছেন।
মোস্তফা গ্রুপের উদালিয়া চা বাগানের উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। কাদেরপুর টি কোম্পানির অধীনে তিনটি বাগান দেশীয় গড় উৎপাদনের চেয়ে বেশি চা উৎপাদন করছে। পাশাপাশি দেশের সবচেয়ে ভালো মানের চা উৎপাদনে কয়েক বছর ধরে শীর্ষস্থানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মধুপুর, সাতগাঁও ও জেমাই বাগানের চা প্রতি বছর নিলামে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পছন্দের প্রথমে থাকছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী ইস্পাহানি গ্রুপের চারটি বাগানেই ভালো মানের চা উৎপাদন হয়। প্রতি বছরই উৎপাদন লক্ষ্য ছাড়িয়ে যায় গ্রুপটির মির্জাপুর, জেরিন, নেপচুন ও গাজীপুর বাগানের চা।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, কাদেরপুর টি কোম্পানি ২০০০ সালে ৭ লাখ ৭০ হাজার কেজি চা উৎপাদন করলেও সর্বশেষ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ৮৪ হাজার কেজি। ম্যাগনোলিয়া ব্র্যান্ডের চা বিপণনকারী এম আহমেদ চা কোম্পানি ২০০০ সালে পণ্যটি উৎপাদন করেছিল ১৯ লাখ ৭০ হাজার কেজি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির চা উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ লাখ ২০ হাজার কেজি। এছাড়া সিলেট চা কোম্পানি ২০০০ সালে ১১ লাখ ৭৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন করলেও ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ লাখ কেজিতে। অন্যদিকে ব্র্যাকের চা বাগানগুলো ২০০৪ সালে চা উৎপাদন করে ১৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২ লাখ ৮২ হাজার কেজিতে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশীয় উদ্যোক্তারা চা উৎপাদনে মনোযোগ বাড়ালেও পিছিয়ে আছে ডানকান ব্রাদার্স। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, আগে ১৫টি চা বাগান থাকলেও বর্তমানে ডানকানের চা বাগান আছে ১৩টি। এ ১৩টি বাগানে ২০০০ সালে ডানকান ব্রাদার্স চা উৎপাদন করেছিল ১ কোটি ২১ লাখ ৮৩ হাজার কেজি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে তারা উৎপাদন করেছে প্রায় এক কোটি কেজি চা। অর্থাত্ দেড় দশকে ডানকানের উৎপাদন কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। একই সঙ্গে কমছে মোট চা উৎপাদনে ডানকানের অবদানও। ২০০০ সালে উৎপাদিত মোট চায়ে বহুজাতিক ডানকানের প্রায় ২৩ শতাংশ অবদান থাকলেও ২০১৫ সালে তা নেমে এসেছে ১৫ শতাংশে।
চা-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একসময় চা উৎপাদনে বড় অবদান থাকলেও বর্তমানে বহুজাতিক ডানকান ব্রাদার্সের উৎপাদনচিত্র বলে দিচ্ছে চা উৎপাদনে প্রতিষ্ঠানটির অনীহার কথা। বেশ কয়েক বছর আগে দেশের প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের চা উৎপাদক ছিল ডানকান। স্বল্পোৎপাদন সত্ত্বেও দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদিত চা সংরক্ষণে আধুনিক ওয়্যারহাউজ নির্মাণ ও ভাড়ায় চালিত ওয়্যারহাউজে চা সংরক্ষণ করলেও ডানকান চট্টগ্রামে একটি মাত্র ওয়্যারহাউজে চা সংরক্ষণ করে। উৎপাদনের তুলনায় ওয়্যারহাউজস্বল্পতায় খোলা মাঠ ও ওয়্যারহাউজের বারান্দায় চা সংরক্ষণ করছে। একসময় উন্নত ব্র্যান্ডের চা বিপণন করলেও তা বন্ধ হয়ে গেছে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের অনেকেই চা বিপণনে বিনিয়োগ করলেও সম্ভাবনাময় এ খাতের ব্র্যান্ডিং থেকে সরে দাঁড়িয়েছে ডানকান। চায়ের পরিবর্তে বাংলাদেশে ভিন্ন ব্যবসায় মনোযোগী ১৩টি বাগানের মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানটি।
চা উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডানকান ব্রাদার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (চা বিভাগ) ইকবাল ইসরাইল খান বলেন, ডানকান এ দেশের মোট চায়ের ২০ শতাংশ উৎপাদন করে। বিকল্প বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও চায়ের প্রতি ডানকানের মনোযোগ সমান রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের চা উৎপাদনে ডানকান শীর্ষস্থান ধরে রাখবে।
জানা গেছে, ডানকান ব্রাদার্স দেশে প্রপার্টি, কনজিউমার পণ্য, ইন্স্যুরেন্স ও লিজিং কোম্পানি ব্যবসায় বেশি মনোযোগী। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হেক্টরপ্রতি গড় চা উৎপাদন দুই হাজার কেজি পার করলেও ডানকান এক হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ কেজিতে সীমাবদ্ধ।
সূত্রমতে, ডানকানের অধিকাংশ বাগান সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায়। বাগানগুলো রয়েছে আলীনগর, অ্যামো, চান্দপুর, চাতলাপুর, ইথাহ, করিমপুর, লাংলা, লাস্কিপুর, মাজধি, নালুয়া, রাজকি, শমশেরনগর ও শিলোয়ায়। একসময় ১৫টি বাগানের মালিকানা ডানকানের কাছে থাকলেও বর্তমানে ডানকানের বাগানের সংখ্যা ১৩। এর মধ্যে করিমপুর ও লাংলা ছাড়া প্রতিটি বাগানের উৎপাদন আগের তুলনায় কমেছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৬টি। ২০১৫ সালে দেশে চা উৎপাদন হয় ৬ কোটি ৬৩ লাখ কেজি। ২০১৪ সালের তুলনায় এ উৎপাদন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। চলতি বছর দেশে পণ্যটির উৎপাদন সাত কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন চা-সংশ্লিষ্টরা।