কৃষি খাত বদলে দিচ্ছে তরুণরা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
আলিমুজ্জামান ঢাকার নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক শেষ করে কৃষিকাজ শুরু করেছেন গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে। এ কিউ এম ফিরোজুল হক স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। এই দুজন মিলে অংশীদারত্বের মাধ্যমে কৃষিকাজ শুরু করেছেন। তবে আলিমুজ্জামান ও ফিরোজুল যে কৃষিকাজ করেন, তার চেহারা কিছুটা ভিন্ন। নিজেরা চাষ করার পাশাপাশি কৃষকদের সমবায় সমিতি করে নিরাপদ সবজি ও ফল চাষের প্রযুক্তি সরবরাহ করেন তাঁরা। তারপর সমবায় কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য শহরে বিক্রির দায়িত্ব নেন ৩০ ও ৩৬ বছর বয়সী এই দুই তরুণ উদ্যোক্তা।
চুয়াডাঙ্গার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সবজি নিয়ে ঢাকায় বিক্রি করা, কৃষি প্রযুক্তি আনতে থাইল্যান্ড ও ভারত পর্যন্ত চলে যাওয়াসহ নানা কিছু করছেন এই দুই তরুণ। আলাপকালে আলিমুজ্জামান তো কৃষিকাজ নিয়ে প্রথাগত শহুরে দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ দিয়েই বসলেন। বললেন, ‘কৃষিকাজ মানে শুধুই গ্রাম্য, মামুলি কাজ, এই ধারণা আমরা বদলে দিতে চাই। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আর মান আমরা দেশেই নিশ্চিত করতে উচ্চশিক্ষা শেষ করে কৃষিতে এসেছি।’
উচ্চশিক্ষিত এই দুই তরুণের উদ্যোগ অবশ্য এখন আর কোনো ব্যতিক্রমী উদাহরণ নয়। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই কৃষির নতুন নতুন খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে তরুণেরা এগিয়ে আসছেন। মৎস্য খামার, ফলের বাগান, সবজি ও মসলা চাষের মতো উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদনে এখন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসছেন তরুণ উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ পল্লী ও কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অর্থায়নে কৃষির বিভিন্ন খাতে প্রায় ২২ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোগকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন ধরনের ফসল ও পণ্য উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন প্রায় তিন লাখ উদ্যোক্তা। তাঁদের গড় বয়স ৩৫। গোলমরিচ, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ, টমেটো ও ড্রাগন ফলের মতো নিশ্চিত মুনাফা আছে এমন খাতগুলোতে এই তরুণেরা বিনিয়োগ করছেন।
পিকেএসএফের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এই তরুণ উদ্যোক্তাদের অনেকেই প্রবাস থেকে ফিরে এসেছেন। অনেকের পরিবারের কেউ কেউ প্রবাস থেকে যে অর্থ পাঠাচ্ছেন, তা এই ধরনের কৃষিভিত্তিক উদ্ভাবনী ও নতুন খাতে বিনিয়োগ করছেন। দেশের ভেতরে সুপারশপ ও উচ্চবিত্ত এলাকার বাজারগুলোতে এসব নতুন ধরনের পণ্য বিক্রি বাড়ছে বলেও সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে পিকেএসএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল কাদের বলেন, ‘আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, তরুণদের হাত ধরে দেশের কৃষি খাত পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পর্যায় থেকে দ্রুত বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তবে এই বদল ধরে রাখতে হলে কৃষকদের ধনী হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। উদাহরণ তৈরি করতে হবে যে উচ্চশিক্ষা শেষে কৃষিতে এলে চাকরির চেয়েও ভালো ভবিষ্যৎ আছে। এ জন্য দেশে ও বিদেশে তাঁদের পণ্যের ভালো দাম এবং বাজার নিশ্চিত করতে হবে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের কৃষিকাজ এখন তারুণ্যনির্ভর। এখন কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী। তরুণদের এই অংশগ্রহণের ফলে কৃষিকাজেও আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বলে মনে করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হামিদুর রহমান।
হামিদুর রহমানের কথার প্রমাণও মেলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কৃষি উৎপাদন-বিষয়ক বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার স্ট্যাটিসটিক্যাল পকেটবুক-২০১৫-তে। সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সবজি চাষের জমি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম আর উৎপাদন বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। আর ফল উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে।
ফল উৎপাদনের সাফল্যের পেছনে যে তরুণ উদ্যোক্তাদের বড় ভূমিকা রয়েছে, তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফলচাষিদের যে তালিকা রয়েছে তা দেখেই বোঝা যায়। সংস্থাটির তালিকা অনুযায়ী, মূলত অবস্থাপন্ন কৃষকদের পরবর্তী প্রজন্ম নানা ধরনের ফল চাষের দিকে বেশি ঝুঁকছে। স্ট্রবেরি, মাল্টা, কমলা, ড্রাগন ফল থেকে শুরু করে বাজারে নতুন ওঠা কালো তরমুজের চাষেও এই তরুণদের প্রাধান্য বেশি দেখা যাচ্ছে।
দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কৃষক মতিউর রহমানের ছেলে নাইজার আহমেদ নাহিদ পিপলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতকোত্তর শেষ করে পারিবারিক ফলের খামার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছেন। ৬১ বিঘা জমিতে বেদানা, মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, গৌড়মতি আম চাষ শুরু করেছেন। তাঁর মতে, ঢাকায় ট্রাফিক জ্যাম, দূষণ আর হট্টগোল মাথায় নিয়ে চাকরি করার চেয়ে গ্রামের প্রকৃতির কোলে নিজেদের খামার আরও বড় করে তোলা অনেক বেশি স্বস্তির, আরামদায়ক ও লাভজনক।
কৃষি খাতে তারুণ্যের অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এস মুর্শিদ বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প খাতেও আমরা তরুণদের অংশগ্রহণ বেশি দেখতে পাচ্ছি।’ তাঁরা আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক বাজারকে মাথায় রেখে বিনিয়োগ করছেন। শিক্ষিত ও তরুণ এই দুই বৈশিষ্ট্য যাঁদের মধ্যে থাকবে, তাঁদের যদি বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ দেওয়া যায় তাহলে দেশের কৃষি খাতের রূপান্তর আরও দ্রুত হবে বলে মনে করেন তিনি।