সরকার চাইলে পশুসম্পদ খাতে উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারে
- মো. সাইফুল বারী
দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের দক্ষিণনগর বিন্যাকুড়ি গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতির চালচিত্র আমার কাছ থেকে দেখা। ছোটবেলায় দেখেছি, গ্রামের গৃহস্থবাড়ির গাভি থেকে দুই থেকে তিন লিটারের বেশি দুধ পাওয়া যেত না। অথচ এখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গড়ে তোলা খামারের উন্নত জাতের একটি গাভি থেকে দৈনিক ১৭ থেকে ১৮ লিটার দুধ পাওয়া যায়। সঠিক জ্ঞান প্রয়োগ করে খামার গড়ে তুললে উৎপাদনশীলতা কতগুণ বাড়ে, এটি তারই একটি উদাহরণ। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। শিল্পের নানা খাতে অগ্রগতি অর্জনের পাশাপাশি যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তোলা যায়, তবে এই লক্ষ্য অর্জন খুব কঠিন হবে বলে মনে হয় না।
২০০৬ সালে দিনাজপুর থেকে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন বা ডিভিএম অনুষদে ভর্তি হই আমি। প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারেই সিজিপিএ-৪-এর মধ্যে ৪ পেয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। পড়ার ভেতরে একটা অনাবিল আনন্দের উৎসও আবিষ্কার করি। অ্যানাটমি, হিস্টোলজি পড়তে প্রাণিজগতের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হয়। ফল হলো এতে। আমি শেষ বর্ষ পর্যন্ত সব সেমিস্টারেই প্রথম হলাম। ২০১২ সালে অনুষদের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হই। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদকও জুটে যায়। পরে উচ্চতর লেখাপড়া শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি ও পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। কাজের সূত্রে দেশের এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন খামার দেখতে হয়েছে আমাকে। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে গিয়ে সে দেশের খামার ব্যবস্থাপনা কাছ থেকে দেখেছি। এসব অভিজ্ঞতা অর্জনের পর মনে হয়েছে কেবল কিছু পরিকল্পনা নিলে এবং সেসব বাস্তবায়ন করলে আমরাও এই খাতে অনেক উন্নতি করতে পারব।
দেশে দুধের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও পোল্যান্ড থেকে গুঁড়ো দুধ আমদানি করতে হচ্ছে। অথচ দেশে দুগ্ধ খামার স্থাপনের মাধ্যমে সহজেই আমদানি-নির্ভরতা কমানো যাবে। আর আমাদের দেশীয় আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, সূর্যালোক ইত্যাদি গরু পালনের জন্য খুবই উপযোগী।
খামারে উৎপাদিত দুধ থেকে দই, ছানা, মাখন, ঘি, সন্দেশসহ বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য প্রস্তুত ও বাজারজাত করে বেকারত্ব দূর করা যায়। আমাদের দেশে প্রতিবছর কোরবানির ঈদে প্রায় ৮০ লাখ গরুর প্রয়োজন হয়। আগে ভারত থেকে প্রায় ২০ লাখ গরু আনা হতো। বর্তমানে ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি গরুর চাহিদা অনেক বেড়েছে। তাই গরু মোটাতাজাকরণের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে গরু মোটাতাজাকরণের বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এ বিষয়ে অনেকে আমাদের কাছে পরামর্শ নিতে আসে। খামার প্রতিষ্ঠা করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গরু মোটাতাজা করলে দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে।
তবে দেশের বাস্তব চিত্রটা কেমন তা কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে সেটা বোঝানো সম্ভব। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৪-১৫ অনুসারে, দেশে বাণিজ্যিক গবাদিপশুর খামার আছে ৫০-৬০ হাজার। তবে এসব খামার দেশের মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশে প্রতিবছর দুধের চাহিদা ১৩ দশমিক শূন্য ১ মিলিয়ন মেট্রিক টন। সেখানে ঘাটতি থাকছে ১০ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মাংসের চাহিদা রয়েছে ৬ দশমিক ২৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। সেখানে ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ৫ দশমিক ২২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। প্রতিবছর প্রয়োজন ১৪ হাজার ৮০৮ মিলিয়ন ডিম। উৎপন্ন হচ্ছে ৫ হাজার ৬৫৩ মিলিয়ন ডিম। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ৯ হাজার ১৭৫ মিলিয়ন ডিম। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০১৪-১৫ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী চামড়া বাদ দিয়ে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পশুসম্পদের অবদান ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আমাদের লক্ষ্য এটাকে ২০২১ সালের মধ্যে ৫-এ উন্নীত করা। আর দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত খামার গড়ে তুললে এটা সম্ভব। আর সেটা করা গেলে এই খাতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি পশুখাদ্য, ওষুধশিল্প, জৈব সার ও জৈব জ্বালানির মতো খাতগুলো আরও বিকশিত হবে। কিন্তু কীভাবে এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেব আমরা?
প্রায় সময় আমার কাছে অনেক লোক খামার সম্পর্কে পরামর্শ নিতে আসেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার খামার দেখে বেশ কিছু সমস্যা চোখে পড়েছে আমার। প্রথমত, বেশির ভাগ মানুষের উন্নত খামার সম্পর্কে ধারণা নেই। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ করার মতো টাকার অভাব। তৃতীয়ত, পুষ্টিকর পশুখাদ্য অর্থাৎ ঘাসের অভাব এবং রোগ-বালাই সম্পর্কে অজ্ঞতা।
উন্নত খামার গড়তে হলে উন্নত জাতের পশু সংগ্রহ করতে হবে। খামারের ছাউনি বা শেড হতে হবে স্বাস্থ্যকর ও আলো-বাতাস চলাচল করার মতো। এ ছাড়া খামারিরা তাঁদের চাহিদামতো ঋণও পাচ্ছেন না। একটি উন্নত জাতের গরুর দাম কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা। অথচ খামার করতে সরকার শতকরা ৫ টাকা সুদে ৫ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে। শতকরা ৫ টাকা সুদে ৪০-৪৫ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হলে একটি ভালো খামার গড়ে তোলা যায়। এ ছাড়া উন্নত জাতের ঘাস যেমন নেপিয়ার ও পারা ঘাস সব জায়গায় পাওয়া যায় না। ঘাসের অভাবে খামারিরা গরুকে দানাদার খাদ্য বেশি খাওয়ান। এতে দুধ কম হয়। সরকারি পতিত জমিতে এসব ঘাসের আবাদ করা গেলে এই সংকট কাটবে।
আমাদের দেশে ভেটেরিনারি চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষজন পশুর রোগ হলে পল্লি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ফলে পশুগুলো প্রকৃত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে পশুর মৃত্যুর হার বাড়ছে। এ অবস্থায় গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন পর্যায়ে কমপক্ষে একজন করে ভেটেরিনারিয়ানের (পশু চিকিৎসক) পদ সৃষ্টিই একমাত্র সমাধান বলে আমি মনে করি।
আমাদের দেশে বেশি মাত্রায় দুধ উৎপাদন করতে পারে এমন জাতের গরু নেই। এ ক্ষেত্রে সংকরায়ণ ভরসা। দেশের পশু হাসপাতালগুলোতে কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্র আছে। তবে সেই সুবিধা আরও বাড়ানো দরকার। এখন হলস্টেন ফ্রিজিয়ান জাতের গরুর সঙ্গে সংকর করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের জার্সি জাতের গরুর সঙ্গেও সংকরায়ণ করা যেতে পারে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভি সাব-ক্লিনিক্যাল ওলান প্রদাহ রোগে আক্রান্ত। সাব-ক্লিনিক্যাল ওলান প্রদাহ রোগে কোনো বাহ্যিক লক্ষণ দেখা যায় না। ওলানে প্রদাহ থাকলে দুধের পরিমাণ কমে যায়। এই রোগ দ্রুত আক্রান্ত গাভি থেকে অন্য দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভিতে ছড়ায়। আমাদের দেশের খামারিরা এ বিষয়ে সচেতন নন। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় এই রোগটি প্রতিরোধে খামারের গরুর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে আমি ফ্রান্সে গরুর রোগ-বিষয়ক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানে গবেষকেরা বলেন, খামারে গরুর রোগ বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর সরকার বেশ গুরুত্ব দেয়। কারণ, তদারকি না করা হলে যক্ষ্মা ও অ্যানথ্রাক্সের মতো মানবদেহের জন্য সংক্রামক রোগও খামার থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ জন্য সেসব দেশে হার্ড (পশুর পাল) হেলথ কর্মসূচি চালু করেছে। এ দেশেও এমন কর্মসূচি চালু করা উচিত।
এবার আসি পোলট্রি খাতের কথায়। দেশে এই খাতটি যথেষ্ট বিকশিত হয়েছে। এখন এখানেই ডিম, বাচ্চা ও মুরগি—সবই উৎপাদিত হচ্ছে। তবে অ্যাভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে এখনো খামারিদের লোকসান গুনতে হয়। এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে পোলট্রিশিল্পের আরও উন্নতি হবে। এ জন্য খামারে পরিচ্ছন্নতার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। খামারে জীবাণুমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
সরকার চাইলে পশুসম্পদ খাতে আরও বহু উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারে। এ জন্য ঋণ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, অল্প জায়গায় এক হাজার মুরগি নিয়ে একটি খামার শুরু করলে একজন তরুণ বা তরুণীকে আর চাকরির পেছনে ছুটতে হয় না। এ জন্য প্রয়োজন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। অল্প দিনেই এই বিনিয়োগ থেকে প্রতি মাসেই লাভ আসবে। মাসে ৩৫-৪০ হাজার টাকা আয় হবে।
যারা আরও বেশি আয়ের স্বপ্ন দেখেন ব্যবসায় বড় বিনিয়োগের ঝুঁকি না নিয়ে তাঁরা ১০টি গরু দিয়ে খামার শুরু করতে পারেন। এ জন্য ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। চার-পাঁচ বছর পর খামার উৎপাদনে গেলে বছরে কোটি টাকা আয় হবে। ভাগ্য পরিবর্তন খুব কঠিন নয় এ দেশে। একটু সাহস, সদিচ্ছা আর উদ্যমই যথেষ্ট।