ব্যবসায়ে অদম্য নারী
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
একজন নারী ব্যবসায়ী হিসাবে যখন উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তখন তার মধ্যে দুটি মনোভঙ্গি একইসঙ্গে কাজ করে। একদিকে মুনাফা, অন্যদিকে সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ। এ দুটি যদি কখনো সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার কাছে দ্বিতীয় মনোভঙ্গিটিই অগ্রাধিকার পায়। কারণ নারী সর্বাগ্রে মা। সমাজের প্রতিটি ঘটনায় নারী বেশি সংবেদনশীল।
বৃটিশ কাউন্সিলের ‘দ্য স্টেট অব সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ইন বাংলাদেশ’ এবং ‘সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ পলিসি ল্যান্ডস্ক্যাপ ইন বাংলাদেশ’ এর গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবসার প্রায় ২০ শতাংশ নেতৃত্ব দিচ্ছে নারীরা, যেখানে সাধারণ ব্যবসার ক্ষেত্রে মাত্র ৫ শতাংশ নারী নেতৃত্বে রয়েছেন। এ ছাড়াও সামাজিক ব্যবসার মোট কর্মশক্তির ৪১ শতাংশই আছে নারীদের হাতে যা অন্যান্য ব্যবসা বা কর্মসংস্থানে নারীদের অংশগ্রহণের দ্বিগুণ। সামাজিক ব্যবসা বলতে আমরা কোন ধরনের ব্যবসা বুঝি? আর এতে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি কেন এবং এক্ষেত্রে নারীদের জন্য মূল বাধা কি তা জানতে কথা হচ্ছিল ডিনেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. অনন্য রায়হান এবং নারী উদ্যোক্তা ফায়জা ফারিয়া আহমেদের সাথে।
ড. অনন্য রায়হান বলেন, সামাজিক ব্যবসা মূলত সে সমস্ত ব্যবসা যাদের ব্যবসায় শুধু মুনাফা অর্জন ছাড়াও আরও একটি লক্ষ্য থাকে। সমাজে তার একটি ফলাফল থাকে। যেমন হতে পারে এটি পরিবেশ নিয়ে বা নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে বা আমাদের বর্তমান ট্রাফিক সমস্যা নিয়ে। যে ধরনের ব্যবসায় লাভ করা কঠিন বা সম্ভাবনা কম। তবু ভালো ফলাফলের জন্য তা করা হয়। অনেক সময় সামাজিক ব্যবসাকে সামাজিক উদ্যোগ বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে লাভ হলে অনেক সময় যারা ব্যবসা করছে তারা নিজেরা ভাগ করে নেয়, কখনো আবার নতুন কাজে পুনরায় ইনভেস্টও করে থাকে। এ ধরনের ব্যবসায় প্রতিযোগিতা তুলনামূলক কম। তাই এগিয়ে যাওয়া সহজ। আর নারীদের মাঝে সংবেদনশীলতা তুলনামূলক বেশি। সেজন্য এ ধরনের কাজে তাদের আগ্রহ ও উত্সাহ বেশি থাকে। এ ধরনের ব্যবসায় মুনাফার পাশাপাশি মানুষের জন্য, সমাজের জন্য এবং সকলের জন্য কিছু করতে পারার তৃপ্তি রয়েছে।
বৃটিশ কাউন্সিলে যে জরিপটি চালানো হয়েছে তাতে প্রায় ১৪৯টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এ জরিপের মধ্য দিয়ে এ ধরনের ব্যবসায় নারীদের অবস্থান খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাঝে অনেক নারী উদ্যোক্তাকে আমি চিনি। তাদের মাঝে একজন উদ্যোক্তা হুমায়রা খান, যিনি মূলত নারী উদ্যোক্তা তৈরি করেন। আরেকজন উদ্যোক্তা রয়েছেন যিনি লাইফবয়ের সৌজন্যে ভাসমান হাসপাতাল চালান। অনেক উদ্যোক্তা ছিলেন আইটি সম্পর্কিত ব্যবসা করেন। এ ধরনের সামাজিক ব্যবসায় নারীদের অংশগ্রহণের হার আরও বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন পরিবারের সহযোগিতা। অনেক সময় সংসার ও পারিবারিক দায়িত্ব সামলিয়ে একজন নারীর পক্ষে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই পরিবার থেকেও তাদের উত্সাহিত করতে হবে।
যে কোনো উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে অর্থ একটি বড় সমস্যা। তাই নারীদের জন্য ঋণ প্রক্রিয়া আরও সহজ করা যেতে পারে। এটি খুব দুঃখজনক যে একজন নারী উদ্যোক্তাকে প্রতি পদে সামাজিক বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। পুরুষের চেয়ে তাদের জন্য অফিস স্পেস ভাড়া পাওয়াও অনেক কঠিন। তাই সামাজিকভাবে প্রতিটি নারী উদ্যোক্তার অগ্রগতির পথে বাধা না হয়ে বরং এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে হবে।
নারী উদ্যোক্তা ফায়জা ফারিয়া আহমেদের সাথে কথা হচ্ছিল তার সামাজিক ব্যবসার অভিজ্ঞতা নিয়ে। তিনি বলেন, বর্তমানে তিনি তিনটি প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। এর মাঝে ইন্টারনাল ডিজাইন এবং কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ষ্টুডিও গ্রীণ। মানাসে মূলত সব ধরনের হ্যান্ডি ক্রাফটস, কূর্তা, শাড়ি গয়না পাওয়া যায় এবং ক্যাফে সঞ্চয়িতায় সব ধরনের অর্গানিক প্রোডাক্টস, যেমন কালিজিরা, সোনামুগ ডাল, লাল বালাম চাল, লাচ্ছা সেমাই এমন বহু কিছু বিক্রি করেন। তিনি প্রায় পাঁচ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। এর আগে তিনি একটি ইউরোপীয় প্রজেক্ট-ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজিতে পাঁচ বছর ডিরেক্টর হিসেবে ছিলেন।
পরে নিজে কিছু করার ইচ্ছা থেকেই ব্যবসার পথে তার যাত্রা শুরু। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়েছেন। নতুন নতুন চিন্তা থেকেই নতুন ব্যবসার ইচ্ছা। বিদেশের নানা ধরনের গয়নার কাছে যখন আমাদের দেশের গ্রামে যারা রুপার গয়না তৈরি করেন তাদের আয়ের পথ বন্ধ হতে চলেছিল, সে সময় তাদের রক্ষায় তার গয়নার ব্যবসা শুরু। তাদেরকে যথাযথ ন্যায্যমূল্য দিয়ে কিনে তিনি সেসব গয়না বিক্রি শুরু করেন। তার ক্রাফটসের জিনিস মূলত টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করেন। বর্তমানে ময়মনসিংহ, শেরপুর থেকে কূর্তা, শাড়ি কিনে থাকেন।