ই-কমার্স খাত নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে চলছে না
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)। ই-কমার্সকে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই সংগঠনটির লক্ষ্য। ই-ক্যাব সভাপতি রাজিব আহমেদ দেশের ই-কমার্স খাত নিয়ে তার চিন্তাভাবনা, অগ্রগতি ও কার্যকর উন্নয়নে ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন
ই-ক্যাবের বর্তমান কর্মকাণ্ড নিয়ে বলুন
ই-ক্যাব হলো দেশের ই-কমার্স খাতের ট্রেড বডি। সংগঠনটি একেবারে নতুন। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই ই-ক্যাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়। একই বছরের আগস্টে জয়েন্ট স্টকের সনদ পায়। ওই বছরেই ১১ অক্টোবর ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সদস্য হয়। পূর্ণাঙ্গ অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে ই-ক্যাবের বয়স এখনো এক বছর পূর্ণ হয়নি। ই-ক্যাব এ সময়ের মধ্যেই খাতসংশ্লিষ্ট সব দিকে কাজ করার চেষ্টা করেছে। সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা এরই মধ্যে পৌনে ৫০০ ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের বেশকিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করছি। যেকোনো বাণিজ্য সংগঠনেরই কাজ হচ্ছে, খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ রক্ষা। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ক্রেতারা অনলাইনে পণ্য ক্রয়ে আস্থা না পেলে ই-কমার্সের প্রকৃত প্রসার ঘটবে না। ই-ক্যাবের চেষ্টায় দেশের ই-কমার্স খাতকে শুল্কমুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছে। ই-কমার্স খাত সম্পূর্ণ ভ্যাটমুক্ত। কিন্তু যেসব কোম্পানি ফিজিক্যাল স্টোর ও অনলাইন দুইভাবে ব্যবসা করে, তাদের ক্ষেত্রে ভ্যাট প্রযোজ্য। শিগগিরই ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ চালু করতে যাচ্ছে ই-ক্যাব। প্রথম ধাপে ১০০ জনকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
বাংলাদেশে ই-কমার্স এখনো খুব বেশি সম্প্রসারিত হয়নি। আশা করছি, ২০১৭ সালের মধ্যে ই-কমার্স খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে ফেলা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আকার কত?
বর্তমান বাজারমূল্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। যেটা বলা হয় তা হলো— উদ্যোক্তা, খাতসংশ্লিষ্ট কোম্পানি, কুরিয়ার সার্ভিস ও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে। কারণ ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ ভিত্তিতে ই-কমার্স খাতের লেনদেন হয় বেশি। এ ধরনের লেনদেনের রেকর্ড সংগ্রহ প্রায় অসম্ভব কাজ। ২০১৬ সালের মধ্যেই দেশের ই-কমার্স খাতের আনুমানিক বাজারমূল্য ১ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে। বর্তমানে ১ হাজারের মতো ওয়েবসাইট ও প্রায় আট হাজার ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইনে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্সের মাধ্যমে প্রতিদিন ২০ হাজার ও মাসে প্রায় পাঁচ-ছয় লাখ পার্সেল সরবরাহ হচ্ছে।
বাংলাদেশে ই-কমার্সের প্রসার কেন দরকার?
চীনের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির বাজারমূল্য এখন ৬০ হাজার কোটি ডলার। কিছুদিনের মধ্যে ভারতের সংশ্লিষ্ট বাজার ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে খাতটির মূল্য এখনো শতকোটি ডলারে পৌঁছায়নি। চীনে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ-ছয় কোটি পণ্য সরবরাহ হয় ই-কমার্সের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সরবরাহের পরিমাণ মাত্র ২০ হাজার।
ফিজিক্যাল স্টোরের মাধ্যমে কেনাবেচা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলে। কিন্তু ই-কমার্সের মাধ্যমে কেনাবেচার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যখন খুশি, তখন পণ্য কিনতে পারছেন। টাকা যত হাত বদল হবে, তত বেশি অর্থনীতির চাকা ঘুরবে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে। ই-কমার্স বা ঘরে বসে কেনাকাটাকে বড়লোকের ফ্যাশন বিবেচনা করা ঠিক হবে না। এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। তা না হলে গোটা বিশ্ব থেকে আমরা পিছিয়ে থাকব।
ট্রেড লাইসেন্সে ই-কমার্স অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া কোন পর্যায়ে আছে?
ই-ক্যাব সভাপতি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে আমার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ট্রেড লাইসেন্সে ই-কমার্স অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আইসিটি বিভাগও যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু সমস্যা হলো— বিষয়টি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। এর সঙ্গে আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয় জড়িত। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশাবাদী কয়েক মাসের মধ্যে কার্যকর সমাধান হবে। ই-ক্যাবের তরফ থেকে যাবতীয় কাগজপত্র এরই মধ্যে জমা দেয়া হয়েছে।
ই-ক্যাবের সদস্য হতে কী ধরনের যোগ্যতা থাকতে হয়?
আমরা চাই তরুণ ও নতুন উদ্যোক্তারা ই-ক্যাবের সদস্য হোক। অনেক অ্যাসোসিয়েশনের তুলনায় ই-ক্যাবের সদস্য হতে তেমন কোনো শর্ত পূরণের প্রয়োজন নেই। শুধু ট্রেড লাইসেন্স ও টিআইএন থাকা লাগে। আর সদস্য ফি মাত্র ৩ হাজার টাকা।
ই-ক্যাব খাতসংশ্লিষ্টদের জন্য কতটুকু সহায়ক?
ব্যক্তিগতভাবে আমি বলব ই-ক্যাব খাতসংশ্লিষ্ট নতুনদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। ই-ক্যাবের ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এ খাতের নতুন উদ্যোক্তাদের সব ধরনের পরামর্শ দেয়া হয়। গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা ৩৫ হাজারের বেশি। এছাড়া একটি ব্লগও রয়েছে। এতে ৩৬০টির বেশি আর্টিক্যাল রয়েছে। ই-কমার্স ব্যবসা শুরু থেকে ঝুঁকিসহ একজন নতুন উদ্যোক্তার প্রয়োজনীয় সব তথ্যই ব্লগটিতে রয়েছে। পাশাপাশি খাতসংশ্লিষ্টদের নিয়ে প্রতি মাসে একটি আড্ডার আয়োজন করা হয়। ই-কমার্স ব্যবসায় আগ্রহীদের সাইট উন্নয়ন থেকে শুরু করে নিরাপদ পণ্য সরবরাহ পর্যন্ত সবকিছুতেই সহায়তা করে ই-ক্যাব।
ই-কমার্স খাতে টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর ই-কমার্স খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের দুই ধরনের প্রভাব রয়েছে। ইতিবাচক দিক হলো— টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের বিনিয়োগ আনলে দেশের সব জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে ই-কমার্স ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। নেতিবাচক দিক হলো— উদীয়মান বাজারটিতে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে। ধরুন গ্রামীণফোনের কাছে ৫ কোটির বেশি গ্রাহকের সেলফোন নাম্বার আছে, যা এ খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। গ্রামীণফোন চাইলেই নামমাত্র খরচে মেসেজ দিয়ে এসব গ্রাহককে তাদের সাইট থেকে পণ্য কেনার বার্তা দিতে পারে।
টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের ই-কমার্স খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের লাইসেন্স আছে কিনা বা এটি আদৌ অবৈধ কিনা, তা সরকার বলতে পারবে। এ ধরনের জটিলতা না থাকলে, তাদের স্বাগত জানানো যেতেই পারে।
ই-ক্যাব খাতসংশ্লিষ্ট একটি নীতিমালা তৈরি করছে। বিষয়টি নিয়ে এক বছর আগে থেকেই সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। মজার বিষয় হলো— নীতিমালার কথা উত্থাপনের পর আমাদের উপহাস করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলো ই-কমার্স খাতে প্রবেশ করছে। চীনের আলিবাবা পরোক্ষভাবে এরই মধ্যে চলে এসেছে। শুনেছি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনও ঢাকায় অফিস নিয়েছে। ফ্লিপকার্টকে দিয়ে মার্কিন এ প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বাজার জরিপ সম্পন্ন করেছে। ২০১৮ সালের মধ্যেই হয়তো বড় ই-কমার্স কোম্পানিগুলো দেশীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করবে। ফলে দেশের ই-কমার্স খাত নিয়ে নিত্যনতুন সমস্যা দেখা দেবে। এজন্য বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের নিরাপত্তায় সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা দরকার।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত ঘিরে কী ধরনের সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন?
বড় সমস্যা হচ্ছে— ক্রমবর্ধমান এ খাত এখনো নিয়মতান্ত্রিক কোনো উপায়ে চলছে না। কার্যক্রম শুরু করলেও বহু প্রতিষ্ঠান শৃঙ্খলাহীন। বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নে একই সঙ্গে সরকার ও উদ্যোক্তাদের সমর্থন দরকার। ই-ক্যাবের ফেসবুক গ্রুপে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ পাই। এক্ষেত্রে আমি গ্রাহকদের ই-ক্যাবের সদস্য এমন সাইট থেকে পণ্য ক্রয়ের পরামর্শ দেব। কারণ সেক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।
ই-কমার্স নীতিমালা তৈরিতে সরকার কতটুকু সহায়ক?
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত ঘিরে নীতিমালার বিষয়ে সরকারের সহায়তার ব্যাপারে আমরা সন্তুষ্ট। সরকার ই-ক্যাবকে নীতিমালা তৈরির দায়িত্ব দিয়েছে। আশা করছি এ বছরের মধ্যে ই-কমার্স নীতিমালার খসড়া তৈরি হবে, যা আগামী বছরের মধ্যে পাস হবে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে কি?
বিনিয়োগ বলা ঠিক হবে না। বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করছে। লাভজনক মনে হলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।
বাংলাদেশে ই-কমার্স প্রসারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা সরবরাহ ব্যবস্থা। বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বর্তমানে ই-কমার্সের মূল বাজার হলো ঢাকা। বিভাগীয় শহর জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এর কার্যক্রম পৌঁছানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্থানীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশেরই নিজস্ব কোনো সরবরাহ ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের সহায়তা নিতে হচ্ছে। করতোয়া, সুন্দরবন বা এসএ পরিবহনের মতো প্রতিষ্ঠান ই-কমার্সের গুরুত্ব এখনো বুঝতে পারছে না। যেসব কুরিয়ার কোম্পানি আগ্রহী, তাদের সামর্থ্য কম। ২০১৭ সালে ই-কমার্স সরবরাহ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে বলে আমি আশাবাদী।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ই-কমার্স সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব কিনা?
ভারতের ডাক বিভাগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ই-কমার্সের সঙ্গে সমন্বয় করে মুমূর্ষু ডাক বিভাগকে পুনরুজ্জীবিত করার সম্ভাবনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা দেশটির সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে এ বছর দেড় হাজার কোটি রুপি লাভের প্রত্যাশা করছে দেশটির ডাক বিভাগ। বিষয়টি আমরা বাংলাদেশের ডাক বিভাগকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছি। এ-সংক্রান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে বিভাগসংশ্লিষ্টরা আশ্বাস দিয়েছেন। আগামী বছর ডাক বিভাগের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
ই-ক্যাব নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
সমস্যা থাকলেও বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। প্রাণ আরএফএল, এসিআই, বিটিআই ও আড়ংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে আমাদের সদস্য হয়েছে। অন্যরাও সংযুক্ত হবে বলে আশা রাখি। শিগগিরই ই-কমার্স হবে দেশের সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি।