ডিজিটাল মার্কেটিং কীভাবে এলো
- ফাহিম আহমেদ
১৯৯০ সালে ওয়েব-১.০ বানানোর সময় টিম বার্নার্স-লি কি কখনও ভেবেছিলেন তাঁর আবিষ্কার ওয়েব- ২.০ তে রূপান্তরিত হয়ে দুনিয়া পুরোদস্তুর ডিজিটাল হয়ে যাবে?
টিম বার্নার্স-লির পরিকল্পনা ছিল তথ্য থাকবে স্ট্যাটিক আকারে যা ওয়েবমাস্টারদের দ্বারা ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে সার্ভারে প্রবেশ করবে এবং ‘কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্কের’ মাধ্যমে গ্রাহককে প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন দিয়ে প্রতি পাতা পড়ার জন্য পয়সা নিবে। কন্টেন্ট একবার সার্ভারে গেলে তা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ ছিল না এমনকি বিজ্ঞাপন ও ব্যান ছিল। ওয়েব-১.০ এর ফিচারগুলোর সাথে আমাদের অভিজ্ঞতার বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে না? মনে হচ্ছে না সাংঘর্ষিক?
লিনিয়ার তথ্য প্রবাহের যুগ থেকে আমরা পতিত হলাম গতিশীল এবং ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাতে থাকা এক ইনফরমেশন হাবে। কারা আমাদের নিয়ে এলো এই তথ্যসমুদ্রে?
২০০৪ সালের দিকে আমেরিকান টেক কনফারেন্স আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান ‘O’Reilly’ ও ‘Media Live’ কর্তৃক আয়োজিত কনফারেন্সে ওয়েব ২.০ কে জনপ্রিয় করে তোলেন Tim O’Reilly ও Dale Dougherty. এর পেছনের কারণ হলো ২০০১ সালে শেয়ারমার্কেটে সব ডট কম কোম্পানির পতন যা ‘ডট কম বাবেল’ নামেও পরিচিত। এই ডটকম বুমের পর যে সকল কোম্পানি টিকে গিয়েছিল তারা সবাই এই কনফারেন্সের মূল বক্তব্য অর্থাৎ ওয়েবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান ও ইউজারের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ব্যপারে একমত হতে পেরেছিল। নতুন নতুন আ্যাপ্লিকেশন যুক্ত হবে এবং বদলে যাবে ‘www’ এর প্রাচীন ধারনা। ব্যবহারকারী চাইলেই ওয়েবসাইট বা সোশ্যাল মিডিয়াতে আ্যাকাউন্ট খুলে নিজের মতামত প্রদান করতে পারবে,পছন্দসই কন্টেন্ট শেয়ার করতে পারবে। কোম্পানির ইচ্ছামতো বিজ্ঞাপন চালাতে পারবে এবং ইউজারকে কুকি প্রদানের মাধ্যমে ইউজারের ডাটা মনিটাইজ করতে পারবে। সংঘর্ষ টের পাচ্ছেন নিশ্চয়? সংঘর্ষের কথা একটু পরে টিম বার্নার্স-লির কাছ থেকে শুনবো। Web 2.0’র নেতিবাচকতা শোনার পূর্বে গোটা পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্যে কীভাবে আমূল পরিবর্তন এলো তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ডিজিটাল বেঁচা কেনার পূর্বেও পৃথিবীতে বেঁচাকেনা অব্যাহত ছিল। প্রথমদিকে বিনিময় প্রথা থাকলেও পরবর্তীতে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি সাধনের ফলে দোকানপাট গড়ে উঠলো। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ব্র্যান্ডের শোরুম চালু করলো এবং সেখানে এসে মানুষজন পণ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে কিনতে থাকলো যাকে ‘ব্রিক এন্ড মর্টার’ বিজনেস মডেলও বলা হয়। বড় বড় কোম্পানিগুলো প্রোডাক্টের সাথে তার ক্যাটালগ দিয়ে দিত যা দেখে কাস্টমার পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে জানতে পারতো। এখনও এই মডেল বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু ওয়েব ২.০ আসার ফলে এই মডেল রূপান্তরিত হল ‘ক্লিক এন্ড মর্টার বিজনেস মডেলে। যার ফলে রিটেইলাররা ফিজিক্যাল শপের পাশাপাশি ই-কমার্স ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বেঁচাকেনা করতে পারছে এবং তাদের প্রোডাক্টগুলো দেশের সীমানা পেরিয়ে ‘গ্লোবাল প্রোডাক্টে’ পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী নিজেদের পণ্য বিক্রয় করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করছে সার্চ ইঞ্জিন ও সোশ্যাল মিডিয়া।
সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইট তৈরি, ওয়েবসাইটকে গুগুল SERPs এ র্যাংক করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় পণ্য বিক্রির কন্টেন্ট বানানো, এড রান করানো, পে পার ক্লিক বা পিপিসি, ইমেইলের মাধ্যমে নিউজলেটার পাঠানো এই সবই ডিজিটাল মার্কেটিং।
ডিজিটাল মার্কেটিং সোশ্যাল মিডিয়া, সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহারকারীদের চোখের সামনেই ঘটছে। তবুও কীভাবে ডিজিটাল মার্কেটিং কাজ করে তা নিয়ে বলার লোভ সামলানো যায় না। ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ একক কোনো কাজ বা বিষয় না। বরং এটি ফুলস্ট্যাক ধারনার মত। অনলাইনে একটি কোম্পানির মার্কেটিং চালানোর জন্য যা যা করা দরকার একজন ডিজিটাল মার্কেটার তা করে থাকেন।
উদাহরণের মাধ্যমে ডিজিটাল মার্কেটিং কীভাবে কাজ করে তা পর্যালোচনা করা যাক।
রকমারি ডটকম তাদের ফেসবুক পেজ থেকে একটি স্পন্সর্ড এড রান করালো যা নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে আপনার সামনে এলো। হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ বইটি আপনি তাদের ওয়েবসাইট থেকে কিনতে পারবেন। বইয়ের কাভরের ছবি দেওয়া এবং একটি ওয়েবসাইটের লিংক ও দেওয়া। লিংকে ক্লিক করে আপনি ওয়েবসাইটে গেলেন। সেখানে বইয়ের দাম, রিভিউ, প্রোডাক্ট ডেসক্রিপশন সবই দেওয়া। আপনি চাইলেই বহুব্রীহি কিংবা ওয়েবসাইট ঘাঁটতে ঘাঁটতে অন্য কোনো বই অর্ডার করতে পারবেন। উক্ত ঘটনাটিতে ডিজিটাল মার্কেটিং কীভাবে কাজ করলো তাই বর্ণনা করবো এবার।
★ রকমারি সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়াতে ওয়েবসাইটের লিংক দিয়ে ট্রাফিক জেনারেট করেছে।
★ সোশ্যাল মিডিয়ায় মার্কেটিং করার জন্য কন্টেন্ট ক্রিয়েট করেছে।
★ ওয়েবসাইট বানিয়ে সেখানে কন্টেন্ট দিতে হয়েছে।
★ গুগুলে রকমারি লিখে সার্চ দিলে প্রথম পাতায় চলে আসে। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের মাধ্যমে তারা গুগুল SERPs এ স্থান করে নিয়েছে।
এখানেই শেষ ডিজিটাল মার্কেটিং? না, শেষ না। উদাহরণে তো কেবল ২-৩ টা প্রক্রিয়ার কথা বলা হলো। এছাড়াও PPC (Pay Per Click), ইমেইল মার্কেটিং, ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং, পডকাস্টের মাধ্যমে অডিয়েন্সের কাছে পণ্যের মার্কেটিং করা হয়।
আজকাল সবাই আমরা ইউটিউব, ফেসবুকে ভিডিও দেখি। ভিডিওর মাঝখানে বা শুরুতে কিন্তু এড দেওয়া হয় এই এডগুলোতে ক্লিক করলেই ভিডিও নির্মাতা যতবার এডে ক্লিক পড়েছে তার উপর ভিত্তি করে টাকা পায়।
ই-মেইল মার্কেটিং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের আওতাভুক্ত হলেও এর প্রচলন বহু আগেই ঘটেছে। কাস্টমারের সাথে সবচেয়ে বেশি ই্ন্টারেকশন নিউজলেটার পাঠানোর মাধ্যমেই হয়ে থাকে । প্রতি সপ্তাহে কোম্পানির কার্যক্রম, ভবিষ্যৎপরিকল্পনা কিংবা বিনোদনমূলক তথ্য শেয়ারের মাধ্যমে কাস্টমারের সাথে বন্ধন দৃঢ় রাখা যায়।
ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংয়ের জগৎটা খুবই ইন্টারেস্টিং। একজন ইনফ্লুয়েন্সার তার ব্লগ, ইউটিউব ভিডিও, পডকাস্টের মাধ্যমে তার নিজের অথবা অন্য কোনো কোম্পানির পণ্য কিনতে কনজিউমারকে উৎসাহ কিংবা নিরুৎসাহিত করে থাকেন। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ডিজিটাল মার্কেটার খালিদ ফারহান যখন তার কোনো ভিডিও কিংবা পোস্টের মাধ্যমে অডিয়েন্সকে কোনো প্রোডাক্ট বা সাইটের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করবেন তখন তার অনুরাগীরা হয়তো সেই প্রোডাক্ট বা সাইট ব্যবহার করতে চাইবে না। কারণ তারা খালিদ ফারহানের দ্বারা ‘ইনফ্লুয়েন্সড’।
প্রত্যেক বড় কোম্পানি বা রিটেইলের এফিলিয়েট প্রোগ্রাম থাকে। কাউকে কোনোকিছু রেকমেন্ড করে বিক্রি করাটা এফিলিয়েট মার্কেটিংয়ে পড়ে যা ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংয়ের সাথে সদৃশ্যপূর্ণ। ব্লগ, ভিডিও, পডকাস্টের মাধ্যমে রেকমেন্ড করা যায়। এ ছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই নিত্য নতুন ‘ডিজিটাল বেচাকেনার’ পদ্ধতি বের হচ্ছে যা এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ডিজিটাল মার্কেটিং করে আয়-রোজগার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অনেক তরুণ-তরুণী স্বাবলম্বী হচ্ছে। তাহলে টিম বার্নার্স-লি কেন web 2.0 এর বিরোধিতা করছেন?
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, যখন তিনি কাউকে দেখছেন একটি ডোমেইন নাম কিনতে একজনকে ৫০০ ডলারের পরিবর্তে ৫০ হাজার ডলার গুণতে হচ্ছে তখন তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন এবং ভাবছেন টাকাটা অপাত্রে গেল বুঝি। World Wide Web এর ৩০ তম জন্মদিনে এর ভবিষ্যত নিয়ে লেখা চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, অনলাইনের মাধ্যমে মানুষের জীবন সহজ হলেও স্ক্যামার, উগ্রবাদী ও বিশৃঙ্খলাকারীদের জন্য অপরাধের জাল বুনতে সহায়তা করছে। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অনলাইন হ্যারেসমেন্ট, হ্যাকিং এটাক, তথ্য বিকৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। আরও সদাশয় হয়ে ওয়েবের নতুন মডেলের কথাও চিন্তা করতে বলেছেন তিনি।
আমরা যদি একটু চোখ কান খোলা রেখে ডিজিটাল দুনিয়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো কীভাবে ইন্টারনেট অব থিংস বা IOT’ র মাধ্যমে ইউজারের সকল ধরনের ডাটা কোম্পানিগুলো নিয়ে নিচ্ছে। এবং পরবর্তীতে সেই ডাটা কীভাবে ইউজারের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে তা কিন্তু আমরা নিশ্চিত না। বেশীরভাগ ওয়েবসাইট ‘Cookies’ প্রদানের মাধ্যমে কিছু ডাটা নিয়ে তারা পরবর্তীতে তা মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে তবে IOT’র ব্যপারে সচেতন হওয়াটা জরুরী। বাংলাদেশ সরকার ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রদানের মাধ্যমে ডিজিটাল মাধ্যম নিয়ে তাদের সতর্কতা বজায় রেখেছে। সবচেয়ে মজার ব্যপার হলো, টিম বার্নার্স -লি ওয়েব-৩.০ বা সিমেন্টিক মডেলের ব্যাখ্যা করেছেন হয়তোবা ওয়েব ২.০ ও ওয়েব ১.০ এর মতো প্রতিস্থাপিত হবে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ও রেলি ডটকম ও এনায়েত চৌধুরীর ব্লগ।