ক্ষুদ্র ব্যবসা : যাত্রা শুরুর সহজ পাঠ
- উদ্যোক্ত ডেস্ক
নতুন কোনো কাজ শুরু করা চ্যালেঞ্জের বিষয়। হোক সেটা ব্যবসা। ব্যবসা শুরু করা কঠিন ও অনেক পরিশ্রমের ব্যাপার। তবে আপনি পরিকল্পনা অনুযায়ী সঠিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যদি ঠিক করতে পারেন, আর পরিশ্রম যদি কাজে লাগাতে পারেন, সফলতা ধরা দেবেই। অনেকেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে ব্যবসায় নামেন। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় একটা সময় ঝিমিয়ে পড়েন। ব্যর্থ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন। অথচ আপনি সামান্য পুঁজি নিয়ে সময়ের কথা মাথায় রেখে নতুন ছোট্ট একটি স্থিতিশীল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে পারলে পরবর্তী ধাপে আপনাকে কী করতে হবে, তা সময় ও বাস্তবতাই শিখিয়ে দেবে। আপনি শুধু কোম্পানি চালিয়ে নেওয়ার পদ্ধতিগুলো মাথায় রাখবেন।
বলে রাখি, এই ক্ষেত্রে রাজ্যের মেধাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। নতুন ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করা ও বাজারে তা প্রসারিত করার প্রাথমিক উপায় খুঁজি, চলুন-
- নতুনে শুরু
কোনো ব্যবসায় উদ্যোগ কিন্তু কোটি টাকা দিয়ে শুরু হয় না। শুরু হয় আপনার-আমার মতো সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক স্বপ্ন আর ইচ্ছাশক্তি নিয়ে। এই স্বপ্ন সফলতা পায় কিছু মৌলিক বিষয় বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে নতুন ব্যবসা শুরুর আগে চেষ্টা করুন নতুন কিছু দিয়ে শুরু করতে। শুরুতেই যেন আপনি ক্রেতাকে চমকে দিতে পারেন।
- উদ্যোগ নেওয়ার পর
চমকে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আপনি পথে নেমেছেন। পথিক হিসেবে হয়তো একেবারেই নতুন। এই নতুন একটা ব্যবসার উদ্যোগ নেওয়ার পর কিন্তু আপনাকে নির্দিষ্ট ট্র্যাকে হাঁটতে হবে। সেটা কেমন, দেখে নিই চলুন-
চাহিদা চিহ্নিতকরণ ও বাজার : ধরুন, আপনি ছাত্রছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে কোনো ব্যবসা শুরু করতে চান। তাহলে তাদের চাহিদা হচ্ছে খাতা-কলম-বইসহ অন্যান্য স্টেশনারি দ্রব্য। এতে কিন্তু আপনার ১ম ও ২য় ধাপ অনুসরণ করা হয়ে গেছে। অর্থাৎ এখানে চাহিদা হচ্ছে চিহ্নিতকরণ আর বাজার হচ্ছে ছাত্রছাত্রী।
চিন্তা : এবার তৃতীয় ধাপে আপনি চিন্তা করুন- এসব ছাত্রছাত্রী কী ধরনের পণ্য বেশি পছন্দ করে বা ক্রয় করে। খাতা-কলম? কী মানের-দামের খাতা-কলম। তাদের গড় ক্রয় ক্ষমতা কত? এ রকম বিষয়-আশয়।
বাজার গবেষণা : এতদিনে নিশ্চয় আপনি বাজার সম্পর্কে একটি ধারণা দাঁড় করাতে পেরেছেন। এবার চতুর্থ ধাপে ঠিক করুন আপনি কী পণ্য বা সেবা নিয়ে বাজারে উপস্থাপন করবেন। আপনি কি পাইকারি বাজারে যা পাওয়া যায় তাই উপস্থাপন করবেন? নাকি নতুন উপযোগিতা সৃষ্টি করে তা বাজারে আনবেন?
পণ্য উৎপাদন : পঞ্চম ধাপে আপনি মন দিন পণ্য উৎপাদনে। হতে পারে আপনি শক্ত মলাটযুক্ত বিভিন্ন মনীষীর জীবনী প্রিন্টকৃত খাতা তৈরি করলেন।
দাম নির্ধারণ : এবার আপনার উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ করুন।
বাজারজাতকরণ : সপ্তম ধাপে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে হবে। অর্থাৎ পণ্য সম্পর্কে বাজারকে অবহিত করতে হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্য সহজ প্রাপ্য করতে হবে।
পণ্য বিক্রয় : এবার গুরুত্ব দিন পণ্য বিক্রয়ে। নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগসহ অন্যান্য প্রণোদনার মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়ে সচেষ্ট হতে হবে।
ক্রেতা অভিজ্ঞতা : অনেকেই মনে করেন, অষ্টম ধাপেই ব্যবসা চক্রের সমাপ্তি ঘটে; আসলে তা নয়।
আপনার পণ্য ক্রেতার প্রয়োজন সফলভাবে মেটাতে পারল কি-না তা জানার দায়িত্ব আপনার। কারণ ক্রেতার পছন্দ না হলে সেই ক্রেতা দ্বিতীয়বার আপনার পণ্য ক্রয় করবে না বরং বাজারে পণ্য সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য ছড়াবে। তাই ক্রেতার অভিজ্ঞতা জানা আবশ্যক।
পণ্য উন্নয়ন : ১০ম ধাপে ক্রেতার অভিজ্ঞতার আলোকে পণ্য উন্নয়ন করতে হবে এবং ১১তম ধাপে আবার পণ্য উৎপাদনে যেতে হবে।
এ ধাপগুলো মেনে চললে যে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আলোর মুখ দেখবেই!
- ঋণের সন্ধান
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত যে অভিযোগ শোনা যায়, তা হচ্ছে- ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ দেয় না। এতে অর্থ সংকটে পড়ে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ শুরুতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ওদিকে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত আফসোস করে বলে, অর্থ দেওয়ার মতো উপযুক্ত উদ্যোগ পাওয়া যায় না। ব্যাংক একটি লাভজনক ও মুনাফাপ্রত্যাশী প্রতিষ্ঠান। ভালো গ্রাহক সন্ধান তার নিজস্ব তাগিদ। বিপণনের জন্য তারা প্রচুর খরচও করে। উদ্দেশ্য একটাই, ভালো এবং নতুন গ্রাহক পাওয়া। এই চোর-পুলিশ খেলা ছেড়ে চলুন আমরা সমাধানের পথে হাঁটি। জেনে নিই ব্যাংক ঋণ পাওয়ার উপায়-
আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক হিসাব বিবরণী : আর্থিক ব্যবস্থাপনা ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রথম ভিত্তি হচ্ছে আর্থিক হিসাব। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা হিসাব ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেয় না। অথচ হিসাব ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব না দিয়ে কোনো ব্যবসা বড় হতে পারে না।
জামানত বিক্রি করা ব্যাংকের উদ্দেশ্য নয় : ব্যাংকের মূল কাজ আমানত নেওয়া ও ঋণ দেওয়া। গ্রাহক ঋণ নেবেন এবং তার আয় থেকে ঋণ শোধ করবেন। ব্যাংক কিন্তু নিজে সরাসরি ব্যবসা করতে পারে না। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এ অনুমোদিত ব্যবসা ব্যতীত অন্য ব্যবসায় ব্যাংক নিয়োজিত হতে পারে না।
ব্যবসায় উদ্যোক্তার আগ্রহ : উদ্যোক্তার কাছে কোনো কোনো ব্যবসা নেশার মতো। যে কোনো মূল্যে তিনি সেটা বাস্তবায়ন করেন। টাকা লাগলে তা জোগাড় করেন। উদ্যোক্তা মাঝে মধ্যে শখের বশে কোনো ব্যবসা হাতে নেন। সফল হলে ভালো, না হলেও অসুবিধা নেই। পরীক্ষার চতুর্থ বিষয়ের মতো। পাস করলে বাড়তি কিছু নম্ব্বর পাওয়া যাবে, ফেল করলে অসুবিধা নেই। এ ধরনের মনোভাব থাকলে এবং ব্যাংক তা বুঝলে পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে।
প্রকৃতপক্ষে ‘কত’ প্রয়োজন : ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ুক বা না পড়ুক ব্যবসা পরিচালনার জন্য উদ্যোক্তাদের বিজনেস প্ল্যান করা উচিত, যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিন বা পাঁচ বছরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এতে আয়-ব্যয়ের হিসাব, ক্যাশ ফ্লোয়ের প্রজেকশন থাকবে। এসব ঠিক থাকলে ঋণ সহজেই পাওয়া যায়।
লেনদেনে সততা : কেবল তাহলেই ব্যাংক ঋণ আশা করতে পারে, যারা লেনদেনে সততা রক্ষা করে। এসএমই উদ্যোক্তা অনেকেই ব্যাংক থেকে আগে ঋণ নেয় না। সে ক্ষেত্রে বিকল্প মাপকাঠি যেমন- বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি বা টেলিফোন বিল নিয়মিত শোধ করা হয় কি-না, তা দেখে।
উদ্যোক্তা ব্যবসা বোঝেন কি-না : অনেক উদ্যোক্তা কোনো একটা ব্যবসায় জ্ঞান-অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও ঋণ চেয়ে বসেন। সেটাও কিন্তু ব্যাংকের দেখার বিষয়।
বিনিয়োগকৃত ব্যবসার ভবিষ্যৎ : বর্তমানে চালু একটা ব্যবসা ভবিষ্যতে খারাপ হয়ে যেতে পারে। ব্যাংক মাঝারি বা দীর্ঘমেয়াদে যে এসএমই ঋণ দেয়, তার বর্তমান রমরমা অবস্থা দেখে সন্তুষ্ট হলেই চলে না; ভবিষ্যৎ চাহিদা এবং বিকল্প পণ্যের সম্ভাবনা বিবেচনায় নিতে হবে।
ব্যাংককে ফাঁকি না দেওয়া : ব্যাংক যেসব কাগজপত্র চায়, অনেক গ্রাহকের তা থাকে না। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে এটি স্বীকার করা উত্তম। ব্যাংক দেখবে বিকল্প কোনো কাগজপত্র দিয়ে কাজ চলে কি-না। না হয় জানিয়ে দেবে, ঋণ দেওয়া যাবে না অথবা কিছুদিন পর নেওয়ার পরামর্শও দিতে পারে।
মনে রাখবেন, ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক আস্থার। আস্থা থাকলে আজ না হলেও আগামীকাল সম্ভাবনার দরজা খুলে যেতে পারে। আর আস্থা নেই তো কিছুই নেই। সুতরাং নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে আপনি নেমে পড়ূন পরিকল্পিত ব্যবসায়। সাফল্য আসবেই!