সুমন সফল মালয়েশিয়ায়
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
অভিবাসীদের জন্য ই-মার্কেটপ্লেস ‘মাইক্যাশ অনলাইন’। মালয়েশিয়াপ্রবাসী দুই বাংলাদেশি মেহেদী হাসান সুমন ও নুরুল হকের তৈরি এই সেবায় আন্তর্জাতিক টপআপ, বাসের টিকিট কাটা এবং বিভিন্ন বিল পরিশোধ করা যায়। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ‘সিড স্টার মালয়েশিয়া’য় সেরা হয়েছে তাঁদের এই ‘মাইক্যাশ অনলাইন’ ।
শুরুর গল্প
উচ্চশিক্ষার জন্য ২০০৭ সালে মালয়েশিয়া যান মেহেদী হাসান সুমন। কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে ভর্তি হন এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশনে। মালয়েশিয়ায় অনেক অভিবাসী। ক্যাম্পাসের আশপাশেও কাজ করে এদের অনেকে। বাংলাদেশির সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো।
শুরুতে এত বাংলাদেশি দেখে খুশি হলেও তাদের নানা সমস্যা জেনে একসময় মন খারাপ হয়ে যায়। স্থানীয় ব্যাংক কম টাকার অ্যাকাউন্ট চালাতে আগ্রহী নয়। এসব অভিবাসীর আয় খুব কম। তাই বাংলাদেশিদের অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে পারছে না। বাধ্য হয়ে তাদের বিকল্প পথে টাকা পাঠাতে হয়।
পড়াশোনা শেষে মালয়েশিয়ায়ই চাকরি নেন মেহেদী। মালয়েশিয়ায় কর্মরত অভিবাসীদের সমস্যা সমাধানে কিছু একটা করতে চাইতেন। এদিকে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে কর্মরত নুরুল হক কম্পানির কাজের সূত্রে মালয়েশিয়া যান। পরিচয় হয় দুজনের। মেহেদীর ইচ্ছার কথা শুনে আগ্রহী হন নুরুল হক। দুজনে মিলে গত বছর নভেম্বরে ‘মাইক্যাশ অনলাইন’ নামে মালয়েশিয়ায় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেন।
বাজার গবেষণা করে তাঁরা জানতে পারেন, মালয়েশিয়ায় অভিবাসী আছে ৩৩ লাখ। এর মধ্যে ২২ লাখই অবৈধ। বেশির ভাগই কারখানা শ্রমিক। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তারা ব্যাংকিং সুবিধা পায় না। মেহেদী হাসানের মতে, ‘ওরা ৫০ বছর পিছিয়ে। অনলাইন বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কিছু করতে পারে না। টাকা জমানোর নিরাপদ উপায় নেই।’
ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত অভিবাসীদের অনলাইন মার্কেটপ্লেসের সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু ‘মাইক্যাশ অনলাইন’-এর। প্রথম সেবা আন্তর্জাতিক টপআপ। প্রথমে ছিল মালয়েশিয়া থেকে মালয়েশিয়া, নেপাল ও বাংলাদেশের মোবাইল অ্যাকাউন্টে টপআপ করার সুবিধা, যার সফটওয়্যার উন্নয়নের কাজ হয়েছে বাংলাদেশে। কুয়ালালামপুরে পাঁচটি এজেন্ট দোকানের মাধ্যমে চলতি বছরের ১ এপ্রিল এই সেবা চালু হয়। প্রথম থেকেই বিপুল সাড়া। এরই মধ্যে তাঁদের সেবায় যুক্ত হয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারের মোবাইল নম্বর।
মালয়েশিয়ায় সাধারণত দূরে কোথাও যেতে বাসের অগ্রিম টিকিট কাটতে হয়। স্টেশনে গিয়ে টিকিট কাটতে ঘণ্টাখানেক লাগে। বাড়তি খরচও হয়। অভিবাসীরা অনলাইনে টিকিট কাটায় অভ্যস্ত না হওয়ায় মাইক্যাশ অনলাইনে চালু হয় বাস টিকিট সার্ভিস। বাস টিকেটিং ছিল অনেক অভিবাসীর কাছে অবিশ্বাস্য। প্রিন্ট করা টিকিট হাতে পাওয়ার পরও তারা জানতে চাইত, ‘এ দিয়ে বাসে চড়তে পারব?’
মাইক্যাশ অনলাইনের আরেক অফার বিল পেমেন্ট। এতে গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা যায় অনলাইনে।
পাঁচ মাসে ২৬ হাজার
২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে মাইক্যাশ অনলাইন। জনপ্রিয়তা পেয়েছে শুরু থেকেই। পাঁচটি এজেন্ট শপ দিয়ে শুরু, এখন ২৬৬টি। বেশির ভাগই কুয়ালালামপুরভিত্তিক। এজেন্ট বাড়ানোর জন্য অভিবাসী বেশি আছে এমন এলাকাগুলোতে প্রায়ই ভ্রমণ করেন দুজন। আবার এজেন্ট শপগুলো জনপ্রিয়তা পাওয়ায় তাঁদের অনেক বন্ধুও এজেন্ট হতে চান এখন।
গত পাঁচ মাসে ৮৮ হাজার ১২৬টি লেনদেনের মাধ্যমে সাত লাখ ৯০ হাজার ৯৩৯ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (দেড় কোটি টাকারও বেশি) লেনদেন করে মাইক্যাশ অনলাইন। ২৬ হাজার ব্যবহারকারী এই সেবা ব্যবহার করেছে। কম্পানির আয় ছিল ২৭ হাজার ৭১৫ রিঙ্গিত।
সিড স্টার চ্যাম্পিয়ন
সামাজিক ব্যবসার ধারণা থেকেই মেহেদী ও নুরুল হক আবেদন করেছিলেন আন্তর্জাতিক সিড স্টার প্রতিযোগিতায়। পৃথিবীর ৫৫টি দেশে এই প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগামী বছর ১ থেকে ৭ এপ্রিল সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে চূড়ান্ত পর্ব। একটি স্টার্টআপকে দেওয়া হবে ১০ লাখ ডলার।
মালয়েশিয়া পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ১ অক্টোবর। বাছাইকৃত ১০টি ধারণা উপস্থাপন করা হয়। মাইক্যাশ মালয়েশিয়া ছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল স্থানীয়দের। সবাইকে ছাড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় দুই বাংলাদেশির উদ্যোগ। চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আগামী মাসে ব্যাংককে অনুষ্ঠেয় এশিয়ার বিজয়ীদের নিয়ে বুট ক্যাম্প এবং ২০১৭ সালে সুইজারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক সিড স্টার প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেবে এ উদ্যোগ।
সিড স্টার মালয়েশিয়ার বিচারক হিসেবে ছিলেন এশিয়া ভেঞ্চার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাই কুক্স, গোবি পার্টনারস বিনিয়োগ পরিচালক ভিক্টর ছুয়া, মাউন্টেন পার্টনারস মালয়েশিয়ার সিইও হাসান আলসাগঅফ এবং টিক ক্যাপিটালের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক রিকশন খাও।
রিকশন খাও বলেন, ‘বিচারকরা এই স্টার্টআপকে বিজয়ী করেছে, কারণ এটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টবিহীন অভিবাসীদের কাছে সেবা পৌঁছাতে পেরেছে। তারা অনলাইনে শপ করতে পারছে।’
দৃষ্টি এখন রেমিট্যান্স সেবায়
নুরুল হক বলেন, ‘সিড স্টারে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা অবশ্যই বড় স্বীকৃতি। তবে আমাদের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থাকলেও মানসিকতা ছিল সেবার। তাই আমাদের দৃষ্টি এখন সামনে।’
মেহেদী হাসান বলেন, ‘প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কম্পানি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাচ্ছে। পেট্রোনাসের মতো বড় প্রতিষ্ঠানও কাজের অফার দিয়েছে। তবে আমরা আগে সরাসরি রেমিট্যান্স সেবা চালু করতে চাই। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নেওয়ার চেষ্টায় আছি। পাশাপাশি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও চুক্তির চেষ্টা করছি। আগামী বছর থেকে এই সেবা শুরু করতে পারব বলে আশা করছি।’
যুক্ত হবে নতুন কিছু
নুরুল হক বলেন, ‘আমরা প্রতি মাসে কমপক্ষে একটি নতুন সার্ভিস নিয়ে আসতে চাচ্ছি। শিগগিরই এয়ার টিকেটিং সার্ভিস চালু করব। এয়ার এশিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে। সাধারণত অভিবাসীরা এজেন্টদের কাছ থেকে বিমানের টিকিট কাটে। অনলাইনে টিকিট কাটলে যে ছাড় থাকে, তা তারা পায় না। আমরা আমাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে তাদের টিকিট কেটে দেব। এখানে ১০-১৫ রিঙ্গিতের মতো একটি সার্ভিস চার্জ রাখার চিন্তা করছি। মালয়েশিয়ার বাইরে সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অভিবাসীদের কাছে পৌঁছানোর পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের।’