তরুণ উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বাংলাদেশে ‘স্টার্টআপ’ বা উদ্যোক্তা আন্দোলনের কৃতিত্ব অনেকখানিই মিনহাজ আনোয়ারের। ব্যবসা শুরু করার কাজটিই সবচেয়ে কঠিন, বিশেষ করে একদমই তরুণ ও নতুন উদ্যোক্তার জন্য। আর এই কঠিন কাজটিই দীর্ঘদিন ধরে করছেন তিনি। অর্থাৎ ব্যবসা শুরু করার কাজটি ধরিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বেটার স্টোরিজ লিমিটেডের চিফ স্টোরিটেলার। এক সাক্ষাৎকারে তিনি মূলত অভিজ্ঞতার আলোকে তরুণ উদ্যোক্তাদের কথা শুনিয়েছেন। বলেছেন নানা সমস্যার কথা, সমাধানের ধারণাও দিয়েছেন।
: তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে আপনার কাজের ধরনটা কী?
মিনহাজ আনোয়ার: উদ্যোগ শুরু করা এবং বড় হওয়ার জন্য আমরা মূলত তরুণ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তিন ধরনের কাজ করি। যেমন, শুরু করার জন্য অনুপ্রেরণা দেওয়া, শুরু করার সময় নানাভাবে সহায়তা করা আর সামগ্রিকভাবে একটা এমন পরিবেশ গড়ে তোলা, যেখানে উদ্যোক্তারা দ্রুত বড় হতে পারবেন।
: কী ধরনের তরুণেরা আপনাদের কাছে আসেন?
মিনহাজ আনোয়ার: মোটা দাগে বলতে গেলে তিন ধরনের—বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে পড়ছেন, কোথাও কয়েক বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে এখন নিজের কিছু করতে চান এ রকম আর ইতিমধ্যেই চেষ্টা করেছেন কিন্তু উদ্যোগ নানা পর্যায়ে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন—এ রকম তরুণেরাই মূলত আমাদের কাছে আসেন।
: কী ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে তাঁরা পড়েন?
মিনহাজ আনোয়ার: প্রথমত, সামাজিক। একটা টগবগে শিক্ষিত তরুণ নিজে কিছু করবেন আমাদের দেশে সেটা সমাজ বা পরিবার কখনো মেনে নিতে চায় না। স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে শুরু করতে মুখোমুখি হতে হয় অনেক কঠিন বাস্তবতার—যেমন ট্রেড লাইসেন্স করতে গেলে লাগবে বাণিজ্যিক এলাকায় অফিস। লিমিটেড কোম্পানি করতে গেলে লাগবে আইনজীবীর ফি বা ভালো কর্মী বাহিনী গড়তে গেলে লাগবে একটা ভালো অফিস—এ রকম কত-কী। প্রথম ধাপেই এসব ধাক্কা পার করে যখন একটু দাঁড়ানোর সময় হলো, দেখা গেল কর্মী বাহিনীর একজন একটা প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি খুলে বসেছে। এই সময় এমন কোনো প্ল্যাটফর্ম তাঁদের থাকে না যেখানে দ্রুত, নিরপেক্ষভাবে এবং সহনীয় খরচের একটা সমাধান কেউ করে দেবেন।
তা ছাড়া পুঁজির অভাব তো আছেই। আরও আছে দেশীয় ক্রেতাদের মূল্য পরিশোধ নিয়ে নানা দীর্ঘসূত্রতা আর টালবাহানা। সবচেয়ে বড় সমস্যা এই মুহূর্তে হচ্ছে দক্ষ কর্মীর অভাব। পুঁজি কষ্ট করে হলেও কিছুটা জোগাড় করা যায় হয়তো শুরুতে। কিন্তু সেই পুঁজি দিয়ে আইডিয়াটি প্রমাণ বা ‘প্রুফ অব কনসেপ্ট’ করা অথবা এগিয়ে নেওয়া বা ‘স্কেলআপ’ করার জন্য দ্রুত এমন একটা দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে হয়, যাঁরা দীর্ঘ সময়ে থাকবেন কোম্পানির সঙ্গে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেটা আমাদের দেশে হয়ে উঠছে না।
: এর সমাধান কী তাহলে?
মিনহাজ আনোয়ার: এর সমাধান করতে হলে আসলে একটা সামষ্টিক এবং জাতীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারিকুলাম পাল্টে ‘প্রবলেম সলভিং স্কিল’ বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শেখাতে হবে। তরুণদের অনুপ্রাণিত করতে হবে, যাতে স্বল্প সময়ের লাভের পরিবর্তে দীর্ঘ সময়ের জন্য চিন্তা করতে পারে, তরুণ উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, যখন তাঁরা শুধু টাকার অভাবে প্রতিদিন হেরে যাচ্ছেন, হয়তো একটা ভালো কর্মীকে ধরে রাখার জন্য তাঁদের বাইরের টাকার চেয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে সময়মতো টাকা পাওয়াটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যেটা আমাদের দেশে একটা বিশাল সমস্যা।
: অনেক বলেন, আমাদের তরুণদের মধ্যে আইডিয়ার অভাব আছে। আসলেই কি তাই?
মিনহাজ আনোয়ার: আইডিয়ার আসলে অভাব নেই, ধৈর্যের অভাব আছে, দূরদৃষ্টির অভাব আছে, লেগে থাকার অভাব আছে। আমরা অনেক সহজেই হার মেনে যাই। অনেক তাড়াতাড়ি বড়লোক হতে চাই এবং ভুলে যাই যে সাফল্য কখনো সহজ নয়।
: যাঁরা আসেন, টিকে থাকেন শেষ পর্যন্ত কী পরিমাণ?
মিনহাজ আনোয়ার: এখন খুবই কম। দশ জনে একজন হয়তো। আশার কথা হচ্ছে এই পরিমাণটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সবাই অনুভব করছেন তরুণদের সহায়তা করতে হবে। এগিয়ে নিতে অনেক এক্সিলারেটর হচ্ছে, তহবিল আসছে। আর একটা সাময়িক পরিবর্তনও আসছে।
: তারপরও তো কেউ কেউ সফল হচ্ছেন। একটু সাফল্যের গল্প শুনতে চাই
মিনহাজ আনোয়ার: নিউজক্রিড বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বড় হচ্ছে এ রকম পাঁচ উদ্যোগের একটা। স্টাইলাইন বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিজেদের মালয়েশিয়ায় সম্প্রসারিত করেছে। শপআপ ইতিমধ্যেই প্রায় ২০০ জন নারী উদ্যোক্তাকে ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করতে সহায়তা করছে।
: তাহলে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এখন কার কী করার আছে? সরকার কী করতে পারে? ব্যাংক কী করতে পারে।
মিনহাজ আনোয়ার: অনেক কিছু। তবে তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। যেমন, ব্যবসা শুরু করার জন্য সব ধাপকে একটা মাত্র সহজ, দ্রুত, অনলাইনভিত্তিক ধাপে আনতে হবে। দেশি গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল আনতে সরকার গ্যারান্টার হতে পারে। ব্যাংকগুলো তাদের সমস্ত কাজ দেশীয় কোম্পানি/স্টার্টআপকে দিতে পারে, যেগুলো অনেক বেশি দামে তাঁরা দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকে নিচ্ছেন। ব্যাংকিং খাতে বিশাল একটা দেশীয় বাজার আছে আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্য। যেটা দুঃখজনকভাবে এখনো বিদেশিদের কাছে চলে যাচ্ছে।
: সবশেষে তরুণ এবং উদ্যোক্তা হতে চান তাঁদের জন্য কী পরামর্শ?
মিনহাজ আনোয়ার: একটা দীর্ঘ কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে পথে নামুন। প্রথম বা দ্বিতীয়বারেই না হোক, তৃতীয় বা চতুর্থ বা হয়তো সপ্তমবারে গিয়ে সফল আপনি হবেনই, যদি তত দিন লেগে থাকতে পারেন। এমন কিছু করুন যেটা করতে আপনি আনন্দ পান, যেটা অন্তত এক কোটি মানুষের প্রয়োজন মেটাবে এবং যেটা বাংলাদেশে আর দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন।