এফ কমার্সের আদিঅন্ত
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
মাস্টার্স শেষে দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর প্রিন্সের মাথায় হঠাৎ এক খেয়াল চাপল। আগে ফেসবুকে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে চ্যাট করে, পোস্ট দিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিতেন। এবার ফেসবুকে তিনি একটা পেজ খুললেন। নাম দিলেন ‘বিভো’। নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, ইসলামপুর থেকে বিভিন্ন আনস্টিচ ও স্ক্রিন প্রিন্টের থ্রিপিস কিনে সেসব জামার ছবি পেজে আপলোড দিতে থাকলেন। তাতে উল্লেখ থাকল দরদামসহ ডেলিভারি দেওয়ার নিয়ম। পেজে লাইকের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকল এবং ইনবক্সে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করল পণ্য সরবরাহের অর্ডার। দিনে দিনে বাড়তে থাকল অর্ডারের পরিমাণ। প্রিন্স জানান, কাস্টমাররা বিকাশের নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন। এরপর তাদের ঠিকানায় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পোশাক পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন প্রতিদিন তিন থেকে চারটা অর্ডার পাচ্ছেন তিনি। মাসে তার গড় আয় ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা।
মুকুল ভালো ছবি তোলেন। বিষয়টা ফেসবুকের একটা পেজের মাধ্যমে জানালেন তাঁর সার্কেলে। বিয়েসহ বিভিন্ন ইভেন্টে তাঁর তোলা ছবি আপলোড করতেন নিয়মিত। এখন তিনি রীতিমতো ব্যস্ত ফটোগ্রাফার। প্রতিদিনই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর ডাক পড়ে।
একটি কম্পিউটার ফার্মে থাকাকালে পিসি মেরামতের কাজটা ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন শিহাব। এ সময়টাতে শিখে নিয়েছিলেন টিভি মেরামতের কাজও। এখন তিনি ঢাকার ধানমণ্ডি ও আশপাশে কম্পিউটার ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশ বিক্রি করেন। পাশাপাশি বাসাবাড়িতে গিয়ে কম্পিউটার ও টিভি মেরামতের কাজ করেন। শিহাব জানান, বেশির ভাগ অর্ডার আসে ফেসবুকের একটা পেজের মাধ্যমে। এখন তিনি ভালো আয় করছেন।
এভাবে এফ-কমার্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের অনেক বেকার তরুণ-তরুণী এখন স্বাবলম্বী। শুধুমাত্র ফেসবুকের মাধ্যমে দেশে ব্যবসা করছে বা নানা ধরনের সেবা দিচ্ছে, এই ধরনের পেজ এখন চার শর ওপর। ঘরে বসেই এসব ব্যবসা পরিচালনা করছেন উদ্যোক্তারা।
এফ-কমার্স কী ও কেন
ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্সই এখন পরিচিত এফ-কমার্স নামে। এটি সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের (এসএমএম) একটা শাখা। অল্প পুঁজিতে, এমনকি বিনা পুঁজিতে এ ব্যবসা করা যায়। কোনো দোকানঘর লাগে না, ব্যবসা পরিচালনা করা যায় ঘরে বসেই। দেশের যেখানেই থাকুন না কেন, ক্রেতার চাহিদামতো পণ্য ডেলিভারি দিতে পারলে এ ব্যবসায় সাফল্য আসবেই। এফ-কমার্সে সফলতা নির্ভর করবে সামাজিক যোগাযোগে আপনার পারদর্শিতার ওপর। আর এ কাজটির জন্য খরচার দরকার নেই। পেজের লাইক সংখ্যা যত বেশি হবে, আপনার পণ্য তত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবে। লাইক বাড়াতে আপনার চেষ্টাই যথেষ্ট। শুরুর দিকে পরিচিতজনদের ‘ইনভাইট’ করুন, বেশি বেশি শেয়ার দিন।
ই-কমার্সের সঙ্গে এফ-কমার্সের পার্থক্য
ওয়েবসাইটে পণ্য বা সেবার তথ্য সাজানো থাকে ই-কমার্সে, থাকে একটি পেমেন্ট গেটওয়ে, যার সাহায্যে ক্রেতারা পণ্য অর্ডারের পর মূল্য পরিশোধ করতে পারেন। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্য পৌঁছে দেয় ক্রেতার কাছে। অন্যদিকে এফ-কমার্সে কোনো ওয়েবসাইটের দরকার হয় না। ব্যবসা পরিচালনা করা যায় ফেসবুকে একটা ব্যবসায়িক পেজে খুলে। এতে থাকে বিভিন্ন পণ্যের ছবি, বিবরণ, দরদাম, যোগাযোগের ঠিকানা প্রভৃতি তথ্য। এখানে কোনো পেমেন্ট গেটওয়ে থাকে না। পণ্য বা সেবা নিতে হলে ফেসবুক পেজে পণ্যের অর্ডার দিতে হয়। চাইলে শোরুমে গিয়েও পণ্য বা সেবা নিতে পারেন ক্রেতা বা গ্রাহক।
টার্গেট কোটি কাস্টমার!
বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ জানুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত এক কোটি ১৮ লাখ। ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যবহারকারী রয়েছেন প্রায় ৯৮ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৭৮ লাখ এবং নারী প্রায় ২০ লাখ। অথচ ২০০৯ সালেও দেশে ফেসবুকের ব্যবহারকারী ছিল এক লাখের কম। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এখন অনেক বড় বাজার। একে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। অনেকেই এখন ফেসবুকেই শুরু করেছেন ব্যবসা। নিজের একটি বিজনেস পেজ খুলে তাতে প্রোডাক্টের ছবি আপলোড করে পণ্য বিক্রি করছেন।
শুরুটা হোক এখনই
আপনি হয়তো মাটির তৈজসপত্র বানাতে পারেন। কিংবা বাইরে থেকে উপহারসামগ্রী বা অন্য কোনো পণ্য আনার সোর্স আছে আপনার। হতে পারে, একটা নির্দিষ্ট এলাকায় ভালো মানের খাবার সরবরাহ করতে চান। অথবা কোনো এলাকায় টিভি, ফ্রিজ বা কম্পিউটার মেরামতের সেবা দিতে চান। শুরু করে দিন। প্রথম প্রথম হয়তো অর্ডার কম পাবেন। আস্তে আস্তে দেখবেন ভোক্তারা আপনাকে ঠিকই বেছে নিচ্ছে। একপর্যায়ে দেখবেন আপনি আর একা সামলাতে পারছেন না, ব্যবসার পরিসর বাড়ানোর জন্য তখন দরকার হচ্ছে লোকবল। ব্যস, আপনি হয়ে গেলেন একজন সফল ব্যবসায়ী।
পেজ তৈরি করবেন যেভাবে
প্রথমে ফেসবুকে আপনার আইডি থেকে www.facebook.com/pages/create ঠিকানায় যান।
এখানে খLocal Business or Place; Company, Organization or Institution; Brand or Product; Artist, Band or Public Figure; Entertainment; Cause or Community নামে ছয়টি ক্যাটাগরি দেখা যাবে। ধরা যাক, আপনি Product ক্যাটাগরিতে থেকে পেজ তৈরি করতে চাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে Brand or Product অংশে ক্লিক করলে দুটি অপশন আসবে। প্রথম অংশে ক্যাটাগরি সিলেক্ট করতে বলা হবে। অন্য অংশে পেজের একটি নাম দিতে হবে। এরপর Get Started বাটনে ক্লিক করতে হবে। এরপর চারটি ধাপ আসবে যা পূরণ করতে হবে। চাইলে কিছু ধাপ Skip করা যাবে। তবে পরে তা পূরণ করতে হবে। প্রোফাইল ছবিও আপলোড করতে হবে। বেসিক ইনফো অংশে কিছু তথ্য দিয়ে অ্যাবাউট অংশে পেজ সম্পর্কে কিছু বর্ণনা দিতে হবে। এবার Continue বাটনে ক্লিক করলে আপনার পেজটি তৈরি হয়ে যাবে। এখন একটি Like বাটন দেখতে পাবেন যাতে ক্লিক করে আপনি প্রথম লাইক দিতে পারেন। এখন কাজ হলো পেজের ওপরের অংশেBuild Audience অপশনে গিয়ে Invite Friends অপশন থেকে আপনার বন্ধুদের ইনভাইট করা। পেজে কোনো পরিবর্তন করতে চাইলে Edit Page বাটনে ক্লিক করে তথ্য পরিবর্তন করা যাবে।
শুরুর আগে
– কী ধরনের পণ্য বা সার্ভিস ডেলিভারি দেবেন প্রথমে তা ঠিক করুন। হতে পারে গয়না, পোশাক, উপহারসামগ্রী বা অন্য কিছু।
– হুট করে শুরু না করে যাচাই করে দেখুন বাজারে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি এবং কোনটি দূর-দূরান্তে ডেলিভারি দিলে ভালো চলবে। শুরুতে অনেক ধরনের পণ্য বিক্রির চিন্তা বাদ দিয়ে এক ধরনের পণ্য নিয়ে শুরু করতে পারেন।
– গুণগত মানসম্পন্ন, আকর্ষণীয় এবং ব্যতিক্রমী কোনো পণ্য বেছে নিতে হবে।
– কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা কারা, তা নির্ধারণ করুন। ছেলে না মেয়েদের জন্য পণ্য ছাড়বেন, তা ভাবুন। তবে শিশু ও নারীদের পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে।
– কোন কোন এলাকায় পণ্য বা সেবা পৌঁছাতে পারবেন তা ঠিক করুন। বাসায় বা শোরুমও রাখতে পারেন।
– পণ্য ডেলিভারির ব্যাপারে ভালো কোনো কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করে রাখুন।
শুরুর পরে
-ব্র্যান্ডিংয়ে মনোযোগ দিন। পণ্য বা সার্ভিসটির উপস্থাপনা স্মার্টভাবে করুন। ফেসবুক পেজে আকর্ষণীয় ছবি দিন।
– আস্তে আস্তে লাইক বাড়াতে থাকুন। এ জন্য আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্য নিন। তাদের বলুন আপনার পেজটা শেয়ার করতে।
– লাইক বাড়ানোর জন্য পেজে ব্যতিক্রমী কিছু পোস্ট করুন। যেমন হতে পারে ধাঁধা বা কুইজ প্রতিযোগিতা, যাতে থাকতে পারে আকর্ষণীয় পুরস্কার।
– অন্যান্য বিজনেস পেজেও আপনার পেজটি প্রচার করুন, তাদেরগুলোও আপনার পেজে প্রচার করতে পারেন।
– বিভিন্ন সাইটে, ব্লগে, মিডিয়ায় পেইজ ও ব্যবসার প্রচার চালান।
– আপনি যে এলাকা থেকে পণ্য সরবরাহ করবেন (হতে পারে আপনার বাসা) তার ঠিকানা, ফোন নম্বর দিন।
– পেমেন্ট সিস্টেমটি ভালোভাবে উল্লেখ করুন, এতে যেন কোনো জটিলতা না থাকে। সেটা হতে পারে মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেমে লেনদেন।