হার না মানা মনির
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
: মামা, ৫০ টাকার একটা গ্রামীণ কার্ড আর একটা কলম দেন।
: এই নেন কার্ড, আর এই কলম।
: কত দিলাম বলেন তো?
: ১০০ দিছেন। নেন ৪৫ টাকা।
: টাকা চিনতে মাঝে মাঝে অসুবিধা হয় না?
: আগে হইতো না, এখন শেখ হাসিনার আমলের টাকাগুলোর সাইজ সব এক করে ফেলছে তো, তাই একটু অসুবিধা হয়। তবে ক্যাম্পাসে অনেক বছর ধরে আছি, তাই কেউ ঠকায় না।
এতক্ষণ যার সঙ্গে কথা বললাম, তিনি একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। নাম তার মনির হোসেন। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘আল বেরুনী’ হলের সামনে ছোট্ট একটি ছাতার নিচে স্টল দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি স্টলে শুধু মোবাইলের কার্ড, কলম, সিগারেট ও কিছু চকোলেট বিক্রি করেন। দিনে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয় তার। এভাবেই চলছে তার জীবন।
কিন্তু মনির হোসেনের এমন জীবন কাম্য ছিল না। কেননা তিনি জন্মগত প্রতিবন্ধী নন। কীভাবে তার এ অবস্থা হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব ছোটবেলায় তখন তার চার বছর বয়স, হঠাৎ একদিন মাথায় প্রচ আঘাত পান। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তারপর থেকেই চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন। তার বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তাকে সুস্থ করানোর জন্য। কিন্তু গ্রামে তখন ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীই রয়ে গেছেন মনির হোসেন। মনিরের বয়স এখন ৩৭ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কখনও তার চলার পথকে রুখতে পারেনি। পড়াশোনা করা হয়নি, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তিনি কর্মক্ষম। বাবার সঙ্গে ১৭ বছর দোকানে বসেছেন। বাবার কাছ থেকেই টাকা ধরে চিনতে শিখেছেন। তার মৃত্যুর পর মনির হোসেন বিভিন্ন সময় চক, প্লাস্টিকের ফ্যাক্টরিতে এবং সর্বশেষ টেলিফোন অপারেটরে চাকরির সুযোগ পান। সংসারে আরও টাকা চাহিদার কারণে সে চাকরি আর তার করা হয় না। এখন তিনি ছোট্ট একটি স্টলে বসে কিছু কার্ড, সিগারেট বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এখানে বসে থেকে কিছুটা আয় করতে পারেন।
তার এ ব্যবসার পেছনে তার মূলধন বা প্রেরণার উৎস কে জানতে চাইলে তিনি বলেন জাহাঙ্গীরনগরের প্রয়াত সাবেক অধ্যাপক ও প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীনের কথা। তার মহানুভবতা ও সহযোগিতাই তাকে এ ব্যবসা শুরু করার মূল ইন্ধন জুগিয়েছিল। পরিবার বলতে তার স্ত্রী ও এক ছেলে। ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে আর স্ত্রী জাবিতে কর্মরত আছেন। পরিবারের অন্যদের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মা সাত বছর ধরে প্যারালাইজড। গ্রামে থাকেন। আর ভাইরা? সবাই পড়ালেখা করে অনেক ভালো জায়গায় আছে। খোঁজ রাখে না। সব শেষে মনির হোসেন অনেকটা তৃপ্তির সঙ্গেই বলেন, অনেক ভালো আছি। সমাজের খারাপ জিনিসগুলো আমাকে দেখতে হয় না।
এভাবেই শেষ হলো তার জীবনের গল্প বলা।