পবনের ব্যাট ব্যবসা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
‘অন্যের কারখানায় কাজ না করে নিজেই কারখানা করব। যেখানে গ্রামের মানুষ কাজ করার সুযোগ পাবে। এমন একটা স্বপ্ন থেকে বছর দশেক আগে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা করি।’ যশোর সদর উপজেলার মিস্ত্রিপাড়া গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা পবন মজুমদারের কথা এমনই।
যশোর শহর থেকে পূর্ব দিকে ১০ কিলোমিটার গেলেই রূপদিয়া বাজার। বাজার থেকে দক্ষিণে ৪ কিলোমিটার পেরোলেই ছায়াশীতল মিস্ত্রিপাড়া গ্রাম। এই গ্রামেই পবন মজুমদারের কারখানা। সম্প্রতি কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, কারিগরেরা ব্যাট তৈরিতে ব্যস্ত। কথা বলার মতো ফুরসত যেন তাঁদের নেই। পবন নিজেই কারিগরদের কাজের তদারকি করছেন।
পবন মজুমদার কাজ করতে করতে বলেন, ‘দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারিনি। তবে কিছু একটা করতে হবে-এমন স্বপ্ন ছিল। নিজে একটা কারখানা দিতে পারব-এমন আত্মবিশ্বাসও মনের মধ্যে রেখেছিলাম। কাঠের কাজ আমাদের আদি পেশা। ব্যাট তৈরির আগে দাঁড়িপাল্লার শলা তৈরির কাজ করতাম। লোহার দাঁড়ি ও স্কেল যন্ত্রের কারণে কাঠের তৈরি দাঁড়ির চাহিদা কমতে বসে। তখন বছর দশেক আগে ব্যাট তৈরির কাজ শুরু করি। কারখানায় স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে ১৫ জনের মতো কারিগর এখন কাজ করেন। এখানকার তৈরি ব্যাট উত্তরবঙ্গের ১৭ জেলাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠানো হয়।’
কারিগরেরা জানান, আমড়া, কদম, জীবন, গেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের কাঠ দিয়ে এসব ব্যাট তৈরি হয়। মূলত এখানকার তৈরি ব্যাট শিশু-কিশোরদের ক্রিকেট খেলার জন্য। টেনিস, টেপ টেনিস ও রাবার ডিউজ বলই এ ব্যাটের জন্য উপযোগী। ১৫ থেকে ৩০০ টাকা দামে এ ব্যাট বাজারে বিক্রি হয়। ভরা মৌসুমে ব্যাটের চাহিদা যেমন বাড়ে, তেমনি সংকট বাড়ে কারিগরের।
এ কারখানার কারিগর সনৎ মজুমদার বলেন, ছোট-বড় সব ধরনের ব্যাট তৈরি করি। ৬ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতিটা ব্যাটের মজুরি পাওয়া যায়। দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা রোজগার হয়। সনৎ মজুমদারের ছেলে পবিত্র মজুমদারও এ কারখানায় শ্রম দেন। পবিত্র যশোর সরকারি সিটি কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের ছাত্র। তিনিও দৈনিক ৩০০ টাকার মতো আয় করেন।
কারিগরেরা জানান, অনেকটা বাড়ির উঠানে বসে আরাম-আয়েশে কাজ করা যায়। এ জন্য এখানকার কারখানায় কাজ করতে বেশ ভালোই লাগে। গ্রামের কেউই এখন আর বসে থাকে না। গ্রামে ব্যাট তৈরির অন্তত ৩০টি কারখানা রয়েছে। নারী-পুরুষ-শিশু বাড়ির সবাই ব্যাট তৈরির এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, পবনের কারখানার মতো বড় কারখানা রয়েছে অন্তত ১০টি। এ ছাড়া ছোটখাটো কারখানা রয়েছে আরও ২০টি। ব্যাটের কাঠামো দাঁড় করানোর পর পালিশ করে চকচকে করা ও স্টিকার লাগানোর কাজটি করেন নারীরা।
গৃহিণী স্মৃতি বিশ্বাস বলেন, ‘পুরুষেরা মূলত ব্যাটের কাঠামো দাঁড় করিয়ে দেন। আর আমরা নারীরা ব্যাটের গায়ে পালিশ ও স্টিকার লাগিয়ে তা বিক্রির উপযোগী করে দিই।’ আরেকজন তরুণ উদ্যোক্তা রিপন মজুমদার। যশোর সিটি কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি বাবার ব্যাট তৈরির কারখানার হাল ধরেছেন। চার বছর ধরে তিনি ব্যাট তৈরির কাজ করছেন। এখন কারখানার তদারকিও করেন।
রিপন মজুমদার জানান, এ শিল্পের বিকাশে মূল বাধা হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকা। কর্মব্যস্ত আট ঘণ্টার মধ্যে চার ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। গ্রামে ঢোকার এক কিলোমিটার সড়ক এখনো কাঁচা রয়েছে। করাতকল থেকে কাঠ আনা ও তৈরি ব্যাট বাজারে নিতে নাকাল অবস্থায় পড়তে হয়। সরকার বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্প এগিয়ে যাবে বলে উদ্যোক্তারা দাবি করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) যশোরের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জামাল উদ্দীন বলেন, ‘মিস্ত্রিপাড়ায় ব্যাট তৈরির অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র এ কুটির শিল্পকে এগিয়ে নিতে সিঙ্গেল ডিজিট (এক একক) সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’