অনন্য উদ্যোক্তা আসমা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বাসা ছিল সিদ্ধেশ্বরীতে। পড়তেন মগবাজার গার্লস হাই স্কুলে। মোবাইল ইন্টারনেট ছিল না তখন। সপ্তাহের শুধু মঙ্গলবারই টিভি দেখার সুযোগ মিলত। তাই অবসর কাটত বই পড়ে। আঁকাআঁকি আর সেলাই–ফোঁড়াই করে। বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। মা গৃহিণী। পাঁচ ভাই–বোনের মধ্যে আসমা সুলতানা তৃতীয়। ডাকনাম আশা। ক্লাস নাইনে থাকতেই প্রথম ড্রেস ডিজাইন করেছিলেন। পোশাক–আশাকে আশা আর দশজনের মতো নয়—বলত লোকে।
পাইলট হতে চেয়েছিলেন
এসএসসির পর আশা পড়তে যান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। ঘোরাঘুরি পছন্দ। তাই পাইলট হতে চাইলেন। সারা পৃথিবী ঘোরার সুযোগ হয়ে যাবে। কিন্তু বাড়ির বড়রা চাইলেন আশা ডাক্তার হোক। শেষমেশ পরিবারের সিদ্ধান্তে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজে।
প্রাইভেটে গণিত পড়তে যেতেন এক স্যারের কাছে। ওই এসএসসি দেওয়ারও আগে। ওই স্যারের কাছে পড়তে আসত গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র তানজিম আশরাফুল হকও। সেখানেই পরিচয়। পরে বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। তানজিমেরও ঘোরাঘুরি পছন্দ। একবার ১৯৯৫ সালের একদিন। আশা তখন মেডিক্যালে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। একদিন রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে দুজনে ভাবলেন, এখনই আমাদের কিছু একটা করা দরকার। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কয়েকজনের গার্মেন্ট বিজনেস আছে। তো তানজিম–আশা ঠিক করলেন ব্যবসা করবেন। টাকা জমানো শুরু হলো। বছরখানেক পর সঞ্চয় দাঁড়াল ২০ হাজার টাকা। সাদা টি–শার্ট কিনলেন বেশ কিছু। নিজেরাই ডিজাইন করলেন। ১৯৯৬ সালে ঢাকার শেরাটন হোটেলে একটা মেলা হয়েছিল। টি–শার্ট নিয়ে দুজনে মেলায় হাজির হয়েছিলেন। দারুণ সাড়া পেয়েছিলেন।
পরিষ্কার মনে আছে
‘অন্য সব স্টলের চেয়ে আমাদের স্টলে ভিড় ছিল বেশি। অতটা সাড়া পাব ভাবিনি। বলতে গেলে নিমেষেই সব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। দুটি ডিজাইন খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেবার। একটার বুকে এ থেকে জেড পর্যন্ত মেডিক্যালের যত টার্ম আছে (যেমন এ ফর অ্যাম্বুল্যান্স) সেগুলো ফুটিয়ে তুলেছিলাম। আরেকটার নকশায় ইংরেজি হরফে লিখেছিলাম, ‘টাফ টাইম নেভার লাস্ট বাট টাফ গাইজ ডু। ’ হাজার পাঁচেক টাকা লাভ হয়েছিল সেবার। তারপর আরো কয়েকটা মেলায় গিয়েছিলেন তাঁরা। এর মধ্যে ধানমণ্ডিতে উইমেন ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (ডাব্লিউভিএ) একটা মেলায় লাভের অঙ্কটা প্রায় লাখের ঘরে পৌঁছেছিল। তারপর তাঁরা ছয় লাখ টাকা লোন নিলেন। ধানমণ্ডির ২৫ নম্বরে একটা শোরুম ভাড়া নিলেন। ১৯৯৭ সালে পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক নিয়ে যাত্রা শুরু করল এক্সটাসি। এরপর ২০০০ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন আসমা আর তানজিম। এখন তাঁদের তিন মেয়ে। আর সারা দেশে এক্সটাসির শোরুমের সংখ্যা ৩০টিরও বেশি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আসমা সুলতানা।
এক্সটাসির ভাই–বোন
২০০২ সালের আগ পর্যন্ত এক্সটাসিতে শুধু ছেলেদের পোশাকই পাওয়া যেত। ২০০২ সাল থেকে মেয়েদের জন্য পোশাক করা শুরু করে। আসমা আর তানজিমের দুই মেয়ে। জারা ও জেইনা। দুয়ের নাম এক করে ২০০৯ সাল লেডিস লাইন নিয়ে যাত্রা শুরু করে জারজেইন। আসমা বললেন, ‘ডিজাইনে আমার কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দেখে দেখেই শিখেছি। প্রথমে নিজের জন্য ডিজাইন করতাম। এখন সবার জন্য করি। চলতি সময়ের খেয়াল রাখি। প্রথম প্রথম চিন্তা ছিল, মানুষ কতটা নেবে? দেখলাম মানুষ সাদরে গ্রহণ করছে। ’
যোএনঅ্যাশ
জোয়ানা আসমা–তানজিমের তৃতীয় সন্তান। আগের দুই সন্তানের নামে জারজেইন করেছেন। ভাবলেন ছোটটির নামেও একটি ব্র্যান্ড চালু করবেন। নিজের নামের কিছু অংশ মিলিয়ে নাম দিলেন যোএনঅ্যাশ। সময়টা ২০১৫। এপ্রিল মাস। বনানীতে প্রথম শোরুম। ঠিক করলেন এর পোশাক হবে বনেদি ও ব্যক্তির রুচিমাফিক। যারা ভিন্ন কিছু পরতে ভালোবাসে তাদের কথা মাথায় রেখেই ডিজাইন শুরু করলেন। শুরুতে শুধু গাউন। এরপর শাড়ি, কামিজ, বিয়ের পোশাক আরো কিছু পোশাক। সবই বিশেষ এবং আলাদা।
মাইকেল এলেন বাংলাদেশে
কিছুদিন পর ‘আইস টুডে’ নামে একটি ম্যাগাজিনে যোএনঅ্যাশ নিয়ে একটা সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। ফেসবুকে সেটা শেয়ার দিয়েছিলেন আসমার এক বন্ধু। ওইটা নজরে পড়েছিল মাইকেল হেরারা নামের এক আমেরিকান ডিজাইনারের। হলিউডের অভিনয়শিল্পীদের জন্য পোশাক নকশা করেন তিনি। আসমার করা গাউন খুব পছন্দ হয়েছে তাঁর। যোগাযোগ করলেন আসমার সঙ্গে। ই–মেইল দেওয়া–নেওয়া হলো অনেক। একদিন মাইকেল জানালেন, তিনি আসমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আসমা তাঁকে স্বাগত জানালেন। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে এলেন মাইকেল। ঘুরে ঘুরে আসমার কাজ দেখলেন। রীতিমতো মুগ্ধ। বললেন, ‘তোমার কাজ ভার্সাসের (জিয়ান্নি ভার্সাস, ইতালির বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার)। কাজের থেকে কোনো অংশে কম না! উইল ইউ ওয়ার্ক উইথ মি?’
অ্যামি অ্যাওয়ার্ডে
২০১৬ সালেই দেশের বাইরে প্রথম কাজের সুযোগ পান আসমা। মাইকেলের মাধ্যমে মিলেছিল সুযোগটা। সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসের মাইক্রোসফট থিয়েটার হলে বসেছিল অ্যামি অ্যাওয়ার্ডের আসর। মার্কিন পপ তারকা রিহানার জন্য তিনটা গাউন বানিয়েছিলেন আসমা। লাল রঙের গাউনে হ্যান্ডওয়ার্ক, লেস আর কারচুপি মিলিয়ে–মিশিয়ে একটা দারুণ নকশা করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে জোয়ান অ্যাশের আরো পোশাক প্রদর্শনের সুযোগ ছিল। তখন আসমার স্টলে এসেছিলেন বলিউড অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, গেম অব থ্রোনসের মেইসি উইলিয়ামসসহ অনেকে।
আসমার পোশাকে ভ্যানেসা কারি
ওই বছরই (২০১৬) আসমার নকশা করা পোশাক এলএ ফ্যাশনের প্রচ্ছদে ওঠে। পরেছিলেন হলিউড সুপার মডেল ভ্যানেসা কারি। পোশাকটিতে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলাদেশের মসলিন, কাতান ও জামদানি। ম্যাগাজিনটির ‘ডিজাইনার স্পটলাইট’ বিভাগের যোএনঅ্যাশ ও আসমাকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদনও ছাপা হয়।
নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইকে
আসমা বললেন, ‘নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইকে অংশ নেওয়া ছিল আমার জীবনের সেরা ঘটনাগুলোর একটি। ’ ৯ ফেব্রুয়ারি ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘যোএনঅ্যাশ ফল/উইন্টার ২০১৭’ রানওয়ে শো অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজকরা প্রশংসা করে বলেছিলেন, আর্ট অন দ্য রানওয়ে। অবশ্য শোয়ের দিন সকালটা অস্থির করে তুলেছিল আসমাকে। প্রবল তুষারপাতের কারণে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। ভাবছিলেন, ‘শো দেখতে শেষ পর্যন্ত দর্শক আসবে তো?’ দুপুর ২টা নাগাদ ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন থিয়েটারে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারপর মডেলদের সাজ–পোশাক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সন্ধ্যা নাগাদ খেয়াল করে দেখলেন, কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারি। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আসমার ডিজাইন করা ৩৪টি জমকালো পোশাক পরে র্যাম্পে হাঁটলেন মডেলরা। মসলিন, কাতান, জামদানি দিয়ে তৈরি হয়েছিল পোশাকগুলো। আসমা বললেন, আবেগপ্রবণ, আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল নারীদের জন্যই পোশাকগুলো তৈরি করা হয়েছে। ’ দর্শকের কাতারে সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের নামিদামি নকশাকাররা ছিলেন। শেষে আসমাকে মঞ্চে ডাকা হয়েছিল। ছোট্ট জোয়ানাকে নিয়ে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে বন্যা, দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে চেনেন আপনারা। অনেকে ভেবে থাকবেন, সেখানে আবার ফ্যাশন কী? কিন্তু আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। আমাদের আছে মসলিন–জামদানির মতো কাপড়, নকশি কাঁথার নকশা। আগামীর বিশ্ব আমাদের। ’ শো শেষে ফ্যাশন টিভিতেও সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন আসমা।
এবার লেডি গাগার জন্য
মার্কিন পপ তারকা লেডি গাগা। গানের পাশাপাশি বিচিত্র ফ্যাশনের জন্য তিনি আলোচিত। ২০১৩ সালের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বসের ৪৫ বছরের কমবয়সী সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছিলেন। আসমার ‘পিকক ড্রেস’ নামে একটা গাউন আছে। সেই ড্রেসটা পছন্দ করেছিলেন লেডি গাগার এজেন্ট। গাউনটা লেডি গাগার কাছে পাঠানও হয়েছে। এখন উত্তরের অপেক্ষা।