নুসরাতের ‘উদ্যোক্তা’ হয়ে ওঠার গল্প
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
নূসরাত আক্তার লোপা। ফেনী জেলার পশুরাম উপজেলার মেয়ে। বর্তমানে থাকছেন রাজধানীর ধানমন্ডি-২৮ নম্বরে। অনেকে শুধুমাত্র অর্থ উপাজর্নের আশায় কাজ শুরু করলেও নুসরাতের বেলায় সেটা ভিন্ন। ছোটবেলা থেকেই একটা কিছু করতে হবে, নিজের পরিচয়ে বেড়ে উঠতে হবে, বাবা-মা, ছোট বোনদের দায়িত্ব নিতে হবে এই ছিল ভাবনা। নুসরাত শুধু নিজেই শিক্ষিত হন নি। পাশাপাশি শিক্ষিত করেছেন তার মাকেও।
নুসরাতের নিজের মুখেই শোনা যাক তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প। তিনি বলেন, স্বপ্ন ছাড়া কিছু হয় না। আর স্বপ্ন দেখে বসে থাকলে চলে না। তার পেছনে ছুটতে হয়। আমার স্বপ্ন ছিল—কিছু একটা করবো। আমি ছোটবোনদের পোশাক আমার পছন্দেই বানিয়ে দিতাম, মায়ের পোশাক বানিয়ে দিতাম। তখন আমার মনে হলো, আমি তো ঘরে বসেই এটা নিয়ে কাজ করতে পারি। তখন একটা সিঙ্গেল কুর্তি বানিয়ে আমার ফেসবুক পেজে দিলাম। অনেক সাড়া পেলাম।
তখন আমার পরিবারের সদস্যরা বললো, তুমি তো এ ধরনের কাজই করতে পারো। একটা কোর্স করলাম। তখন অভিজ্ঞতা হলো ফেসবুক পেজ নিয়ে। ফেসবুকে কিভাবে পণ্য বিক্রি করতে হয়, বেশ আইডিয়া হলো।
সেটা ছিল ২০১৫ সালের কথা। আমি ওই সিঙ্গেল কুর্তি দিয়েই ‘হুর নুসরাত’ নামে একটা ফেসবুক পেজ খুললাম। এরপর মাঝের দুই বছর কীভাবে গেছে আমি নিজেও জানি না। গত ঈদে টানা ৭২ ঘন্টা না ঘুমিয়ে ক্লায়েন্টদের অর্ডার নিয়েছি। ড্রেস নিজ হাতে ভাজ করেছি। এরপর সেগুলো প্যাক করেছি, কুরিয়ার করেছি, দেশের বাইরে পাঠানোর কাজগুলোও করেছি। ২০১৬ সালের বৈশাখ থেকে ঈদের মধ্যে আমি মোটামুটি একটা পরিচিতি পেয়ে যাই। তখন মনে হলো আমি একটা কিছু করছি। হয়তো আমার একটা রং পছন্দ হয়েছে, সেখান থেকে একটা সুতা কেটে রাখতাম। একটা সাদা শাড়ীতে পছন্দের রঙের সুতাগুলো স্কচটেপ দিয়ে বসিয়ে তাঁতীকে বুঝিয়ে দিতাম। সেখান থেকে শাড়ি তৈরী হতো, সেই শাড়িগুলো ফেসবুকে আপলোড করতাম। এভাবে খুব সাড়া পেলাম। এখন মোটামুটি অর্ধশত কর্মী কাজ করছেন আমার সঙ্গে। আমার পোশাকগুলো দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, লন্ডন, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে। অর্থাৎ যেসব দেশে বাংলাদেশি আছে, সেসব দেশেই আমার পোশাকের চাহিদা আছে।
শতভাগ দেশীয় পণ্য নিয়ে আমি কাজ করি। শাড়িগুলো একদম হাতে বোনা, আসে ঠাকুরগাঁও থেকে। আমি নিজে ডিজাইন দিয়ে রং করে শাড়িগুলো আনি। শাড়ি, থ্রিপীসগুলো ন্যাচারাল ডাইং করা, পার্টি ড্রেস ও শাড়ি রয়েছে। স্টোন, পাতি, সব কিছু দেশী। কেউ হয়তো শুধু শাড়ি, বা থ্রি-পীস নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু আমার এখানে প্রত্যেকটি পণ্য আছে। কোনো নিম্নমানের পণ্য আমি ব্যবহার করি না।
ছেলেবেলার বেড়ে ওঠা আর নিজের জীবনের পেছনের গল্প বলতে গিয়ে নুসরাত বলেন—আমি সংসার বোঝা শুরু করেছি মাত্র ১০ বছর বয়সে, যখন ৫ম শ্রেণীতে পড়ি। আমার মা ছিলেন গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে। আর বাবা ছিলেন ঠিক তার বিপরীত, তিনি ছিলেন খুব বিত্তশালী ঘরের ছেলে। এ রকম প্রতিটি বিষয়ে তাদের মধ্যে অনেক ফাঁক ছিল। অপরদিকে আমার চাচীরা ছিল অনেক শিক্ষিত। আমার মা তুলনামুলক একটু কম শিক্ষিত, বুঝতোও কম। যে কারণে আমার মাকে অনেক গালমন্দ শুনতে হতো। আমি ছোট ছিলাম। কিন্তু এসব আমাকে পীড়া দিত।
আমরা শুধু তিন বোন। সবাই বলতো, ‘ওদের ভাই নাই, ওদের বাবা-মাকে কে দেখবে? তখন থেকে মনে মনে আরেকটি সংকল্প আমার ভেতর তৈরী হলো-‘আমাদের ভাই নাই তো কি হয়েছে? আমার মা-বাবাকে আমিই দেখবো। তখন থেকে আমি আমার মায়ের দেখাশোনা, বোনদের ভালোমন্দ দেখতাম।
আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন আমি আমার মাকে জোর করে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়াই। এরপর আমি যখন এসএসসি পাশ করি তখন তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং আমার বিয়ের পর আমি আমার মাকে মাষ্টার্স পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাই। আমার আসল যুদ্ধটা আসলে ওখান থেকে শুরু।
অনার্স প্রথম বর্ষে আমার হুট করেই বিয়ে হয়ে গেলো। এরপর আমি যখন মাষ্টার্স পাশ করলাম, তখন আমার ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করলাম। আমি কেন বসে থাকবো। আমাদের ভাই নেই, আমার ছোট দুটো বোন আছে। বড় হিসেবে ওদের দায়িত্ব আমার নেয়া উচিত। চাকরির পেছনে অনেক ছুটেছি। অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছি। সিলেক্ট হয়েছি, কিন্তু স্বামীকে রাজি করতে পারিনি বলে চাকরি করা হয়ে উঠেনি। এ কারণেই আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।