ঢেলে সাজানো হচ্ছে উদ্যোক্তা তহবিল
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
আগের ভুলভ্রান্তি শুধরে নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রকল্প সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল বা ইইএফ। বিনিয়োগের সুরক্ষার স্বার্থে সরকার ইইএফে নিজের বিনিয়োগের পুরোটা শুধু মূলধন হিসেবে নয়, কিছু অংশ ঋণ আকারে দেবে। ঋণের বিপরীতে প্রকল্পের সমুদয় সম্পদ জামানত রাখবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইইএফ চুক্তি অনুযায়ী মূল উদ্যোক্তা সরকারের বিনিয়োগ ফেরত না দিলে প্রকল্পের সম্পত্তি বিক্রি করে সরকার যাতে নিজের অংশ ফেরত নিতে পারে, তার জন্যই এ ব্যবস্থা। পাশাপাশি যেসব প্রকল্প থেকে সরকার বিনিয়োগ ফেরত পাচ্ছে না, সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ বা সরকারের শেয়ার তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগ আরও জোরদার করা হবে। এর আগে সর্বোচ্চ ১২ কোটি টাকার প্রকল্পে ইইএফ থেকে মূলধন জোগান দেওয়া হতো। এ আকার বাড়িয়ে ২০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনূসুর রহমানের সভাপতিত্বে ইইএফ বিষয়ে একটি সভা হয়। ওই সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইফতেখার-উজ-জামানও অংশ নেন। প্রতিষ্ঠানটি ইইএফ প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে। শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ দায়িত্বে ছিল। আগামী ১৪ জুন এ বিষয়ে আরও একটি সভা হওয়ার কথা আছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগামী মাস থেকে ইইএফ নতুন করে চালুর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে। তবে এর আগেই এ প্রকল্প পরিচালনায় যেসব ভুলভ্রান্তি ছিল, তা চিহ্নিত ও সম্ভাব্য সমাধান প্রক্রিয়া জেনে নিতে বলা হয়েছে।
ইইএফ হলো দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে সরকারের একটি বিশেষ কর্মসূচি। এর অধীনে কৃষি, মৎস্য, দুগ্ধ, তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প বা এ জাতীয় ছোট বা মাঝারি শিল্প সৃষ্টি করতে সরকার সহ-উদ্যোক্তা হিসেবে মূলধন জোগান দেয়। ২০০০ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু হয়।
ইইএফ প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না এবং কাঠামোগত দুর্বলতার সুযোগে অনেকে সরকারের অর্থ মেরে দিচ্ছে- এমন অভিযোগের প্রেক্ষাপটে পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনার স্বার্থে গত মার্চ থেকে এ প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য কোনো প্রস্তাব নেওয়া হচ্ছে না। আইসিবি সূত্র জানিয়েছে, গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৯২৪টি প্রকল্পে গত ১৭ বছরে সরকার মোট ১ হাজার ৪১৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ আট বছর শেষ হয়েছে ২৩১টি প্রকল্প। চুক্তি অনুযায়ী এসব প্রকল্প থেকে সরকারের মূলধনী বিনিয়োগ ৫৩৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ফেরত পায়নি।
আইসিবির কর্মকর্তারা বলেন, অনেকে ইইফকে সুদবিহীন ঋণ বলে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের প্রকল্পে সরকারও বিনিয়োগকারী। প্রকল্প লাভজনক হলে লভ্যাংশ দেবে, না হলে না। লাভ হলেও লোকসান দেখিয়ে লভ্যাংশ দেয় না বলে একে সুদবিহীন ঋণ বলে মনে করেন অনেকে। নতুন নীতিমালা হলে এ ধারণা থাকবে না।
সূত্র জানায়, ইইএফের অধীনে পরিচালিত প্রকল্পের মেয়াদ কমপক্ষে তিন বছর হয়েছে এমন প্রকল্প ৬২৯টি। আইসিবির পক্ষ থেকে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, এর মধ্যে ৩০২টি পূর্ণ বাণিজ্যিক কার্যক্রমে আছে। যা মোটের ৪৮ শতাংশ। এ ছাড়া আংশিকভাবে উৎপাদনে আছে ২০৭টি, বাস্তবায়নাধীন ৫৭টি। আর ৬৩টি পুরোপুরি অকার্যকর অবস্থায় আছে, যা মোটের ১০ শতাংশ। পুরোপুরি অকার্যকর বা সরকারের থেকে মূলধন নিয়ে প্রকল্প শুরু করেননি বা শুরু করেও ঠিকভাবে চালাচ্ছেন না বা চালু থাকলেও সরকারের মূলধন ফেরত দিচ্ছেন না এমন প্রকল্পগুলোর উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করছে সরকার। এখন পর্যন্ত এমন ১০টি প্রকল্পের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
সর্বশেষ ২৩ মে ইফাডাপ এ্যাকোয়া নামের বগুড়ার আদমদীঘির ফিশারিজ প্রকল্পের বিরুদ্ধে রিট করে নিজের পক্ষে রায় পেয়েছে সরকার। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কোম্পানিটির মূল উদ্যোক্তাদের অবসায়ন করে কেন সরকারের মূলধন ফেরত দেওয়া হবে না, তা জানতে রুল দিয়েছেন। একইভাবে আরও নয়টি প্রকল্পের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচটি প্রকল্পে সরকারের শেয়ার বিক্রি করার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। আরও প্রকল্পে একই ধরনের পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আইসিবির ইইএফ প্রকল্পের মহাব্যবস্থাপক মো. রেফাত হাসান বলেন, অনেকে মনে করেন প্রকল্পটি একেবারে ব্যর্থ, যা সত্য নয়। অথচ সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, ইইএফ প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৬ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
৫১০টি মৎস্য প্রকল্প থেকে বছরে ৫ হাজার টন মাছ, ৩৮টি দুগ্ধ খামার থেকে বছরে ৬৪ লাখ ৪০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। বাস্তবায়নাধীন আরও ১৬৪টি প্রকল্প থেকে বছরে প্রায় ২৯৫ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হবে। ৮৮টি আইসিটি প্রকল্পে অর্থায়ন করা হয়েছে আরও ৪৭টি প্রকল্পে অর্থায়ন প্রক্রিয়াধীন আছে।
আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইফতেখার-উজ-জামান বলেন, ইইএফ প্রকল্প নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। অনেকে মনে করেন, ইইএফ প্রকল্পের পুরো টাকাই মেরে দেওয়া হচ্ছে। যা সত্য নয়। এ প্রকল্প থেকে সরকার একবারে পুরো অর্থ ছাড় করে না। প্রথম ধাপে একটি অংশ ছাড়ের পর পরবর্তী ধাপের অগ্রগতি না থাকলে অর্থ ছাড় হয় না। ফলে সরকারের পুরো টাকা মার যাওয়ার ধারণা সত্য নয়।
তিনি বলেন, কিছু বাজে বিনিয়োগ হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু ইইএফের সফলতার গল্পও ছোট নয়।