ফেসবুকে সাড়ে ৯ হাজার পেজে জমজমাট বাণিজ্য
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
শাহাদাত হোসেন পেশায় মার্চেন্ডাইজার। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। এরপর রাতের বাকি অংশ আড্ডায় অথবা ফেসবুকে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিংয়ে সময় কাটান। ফেসবুকিং করতে করতে একদিন হঠাৎ চোখে পড়ল একটি পেজ- যেখানে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা থ্রি-পিস বিক্রি করা হচ্ছিল। আগ্রহ বশত কমেন্টগুলো পড়তে গিয়ে দেখলেন অনেকেই থ্রি-পিসের দাম ও কীভাবে তা ডেলিভারি দেয়া হয়- সে বিষয়ে জানতে আগ্রহী। এরপরই মাথায় চিন্তা এলো; বন্ধু ও চাচাতো ভাইদের নিয়ে নিজেই একটি পেজ খুলে ব্যবসা শুরু করবেন। যে কথা সেই কাজ। অল্পদিনের মধ্যেই ‘অরেঞ্জফ্যাশনবিডি’ নামের একটি পেজ খুলে নিজের ব্যবসা শুরু করলেন; যা এখন জমজমাট।
জানতে চাইলে শাহাদাত হোসেন বলেন, আমার মতো বর্তমান তরুণ প্রজন্মও এখন ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি সময় কাটায়। তারা ফেসবুকে কেনাকাটা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারণ ফেসবুক পেজগুলোতে একটু আলাদা স্টাইলের পণ্য কম দামে পাওয়া যায়। পণ্যের ছবি ও বর্ণনা দেখে পছন্দ করা যায়। নিজে যেহেতু মার্চেন্ডাইজার তাই পোশাকের ডিজাইনের বৈচিত্র্যগুলো সহজেই অনুধাবন করতে পারি। এজন্য বন্ধু ও ভাইসহ চারজন নিয়ে ফেসবুকে পেজ বানিয়ে ব্যবসা শুরু করেছি। এখানে পুঁজিও তেমন একটা নেই। বলা যায়, পুঁজি ছাড়া ব্যবসা। অল্পদিনেই ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
জানা গেছে, এখন ফেসবুক শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়, অনলাইন কেনাবেচার সবচেয়ে বড় মাধ্যম বা মার্কেট প্লেস হয়ে উঠেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্বল্পশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, বেকার এমনকি চাকরিজীবীরাও পার্ট টাইম কাজের অংশ হিসেবে ফেসবুকে পেজ খুলে স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসায় নামছেন। শুধু তাই নয়, অ্যামাজন বা বাংলাদেশের দরাজডটকমের মতো বড় বড় ই-কমার্স সাইটগুলোও তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ফেসবুকে।
কয়েকটি ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে সুতি কাপড়, জামদানি, মসলিন, সিল্কের শাড়ি, মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের পোশাক, আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, শার্ট, জিন্স প্যান্ট, জুয়েলারি, ঘড়ি, চশমা, চামড়ার বেল্ট, ওয়ালমেট, মানিব্যাগ, ঘর সাজানোর সামগ্রী, রূপচর্চার সামগ্রী, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, টিভিসহ সব ধরনের গৃহস্থালি সামগ্রী। এছাড়া পশু-পাখিও বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে পারসিয়ান বিড়াল এবং বিভিন্ন জাতের কুকুরের চাহিদা বেশি। এ ধরনের ওয়েব পেজে ৭ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত লাইক লক্ষ্য করা গেছে।
ফেসবুকে সক্রিয় এমন কয়েকটি পেজের অ্যাডমিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবসার মূল কারণ হল পুঁজি ছাড়া বা স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসা। এজন্য কোনো বাড়তি জায়গা বা লোকবলেরও প্রয়োজন নেই। শুধু দরকার লেপটপ বা মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ। ঘরে বসেই এ ব্যবসা করা যায়। ক্রেতারা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখে পছন্দ হলে মোবাইল ফোনে অর্ডার দিচ্ছেন। পরে তা ক্রেতার ঠিকানায় নিজে অথবা প্রতিনিধি দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে ঢাকার মধ্যে ফ্রি হোম ডেলিভারি দেয়া হয়। আর ঢাকার বাইরে নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে পণ্য কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো হয়। অনেক উদ্যোক্তা আবার শুধু পণ্যের ছবি আপলোড করে দিচ্ছেন। ক্রেতা অর্ডার দিলে তা সংগ্রহ করে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে আগে থেকে মূল বিক্রেতার সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখেন। উদ্যোক্তারা শুধু কমিশন পান। তাদের কাজ শুধু ঘরে বসে ক্রেতা-দর্শনার্থীর প্রশ্নের উত্তর এবং নতুন পণ্যের ছবি আপলোড দেয়া। বর্তমানে নতুনদের পাশাপাশি বিশ্বের বড় মাপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের পণ্যের প্রচারে ব্যবহার করছে ফেসবুক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি রেজওয়ানুল হক জেমি বলেন, বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার ফেসবুক পেজে পণ্য কেনাবেচা চলছে। সাবসিডিয়ারি পেজ (ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনকারী সাইট) হিসাব করলে তা ১৫ হাজার ছাড়াবে। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে। ফেসবুকে ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রথম ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এভাবে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের এসএমই খাতের যেভাবে বিকাশ হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি। কিন্তু ফেসবুক অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্ম দিয়েছে। এর প্রধান কারণ, ফেসবুকে স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসা করা যায়। পণ্য নিয়ে মানুষের দরজায় দরজায় যাওয়া লাগছে না। ক্রেতা ফেসবুকে পণ্য পছন্দ হলে অর্ডার দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে ব্যবসা স্থাপন খরচ নেই বললেই চলে। তাই ফেসবুক কমার্সে তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে।
ফেসবুক পেজের মাধ্যমে নিয়মিত কেনাকাটা করা আবু হাসান মণ্ডল বলেন, চাকরির কারণে ব্যস্ত থাকায় শপিং মলে গিয়ে পণ্য কেনা হয় না। এর বদলে ফেসবুকে সার্চ দিলেই বের হয়ে আসছে নানা পেজ। যেখানে যে কোনো ধরনের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব পেজে লাইক দিয়ে রাখার কারণে নতুন যে কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনই ফেসবুক খুললেই দেখা যায়। তিনি জানান, একটু ভিন্নধর্মী গিফট আইটেমই ফেসবুক থেকে বেশি কেনেন তিনি।
আছে প্রতারিত হওয়ার ভয়ও: ফেসবুক পেজ থেকে অর্ডার দিয়ে পণ্য কিনলে প্রতারিত হওয়ার ভয়ও আছে। কারণ পেজগুলোতে অরিজিনাল পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া হলেও ক্রেতাকে পণ্যের নকল কপি গছিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মনিটরিং না থাকায় ক্রেতারা অভিযোগও জানাতে পারছেন না। এতে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসা সম্প্রসারণ হচ্ছে না।
কয়েকটি বিজনেস পেজ ঘুরে পণ্যের বিজ্ঞাপনের কমেন্ট অপশনে গিয়ে দেখা গেছে, নতুন ক্রেতারা পণ্যের দরদাম ও ডেলিভারি পদ্ধতি জানতে চাচ্ছেন। আবার যারা পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন তারা নানা ধরনের গাল-মন্দ করছেন। তবে নেতিবাচক কমেন্টগুলো পরবর্তী সময়ে আর দেখা যায়নি। কারণ দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগুলো ডিলিট করে দেয়া হয়।