উদ্যোক্তাবৃত্তি কেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি
- টিমোথি কার্টার
আমরা প্রায়ই শুনি যে উদ্যোক্তাবৃত্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবে বৃহত্তর অর্থনীতির জন্য উদ্যোক্তাবৃত্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবন করা বেশ শক্ত। উদ্যোক্তাবিষয়ক কর্মকাণ্ড কিংবা অন্যঅর্থে যাকে বলা হয় স্থানীয় অর্থনীতিতে সহায়তাকারী নতুন ব্যবসা, তা আমাদের দেশীয় প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং পুঁজিবাজারকে ক্রমশ উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। তাহলে উদ্যোক্তাবৃত্তিই কী অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী চালিকাশক্তি? আসলে আপনি যা ভাবছেন, এটি তারচেয়েও অনেক জটিল একটা ব্যাপার।
ক্ষুদ্র ব্যবসা, নতুন ব্যবসা ও চাকরি বাজারের ক্রমোন্নয়ন
ইতিহাস বলছে, সব সময়ই ক্ষুদ্র ব্যবসার সৃষ্টি হয়েছে উদ্যোক্তাদের হাত ধরে। এরাই চাকরির বাজার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন। যুক্তরাষ্ট্রে ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর পনের লাখ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে থাকে। এই সংখ্যাটি নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির ৬৪ শতাংশ।
নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ অর্থনৈতিক উন্নতি অনেকটাই নির্ভর করে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির উপর। যত বেশি কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে তত বেশি মানুষ কাজ করবে। আর অধিক কর্মশীল মানুষ প্রবৃদ্ধিকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে। কর্মজীবী মানুষেরা তাদের পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে থাকে। পাশাপাশি সঞ্চয় করে থাকে। পরর্ব্তীতে সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করে।
অন্য ব্যবসার উপরে প্রভাব
আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি, ছোট ছোট ব্যবসা অন্যান্য ব্যবসার উপরেও প্রভাব ফেলে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আপনি নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করার পর আপনার ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করার জন্য স্থানীয় বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, সেখানে যারা ব্যবসা করছে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি করবেন। আবার এখন যেহেতু ডিজিটাল যুগ, সুতরাং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের জন্যও আপনাকে ডিজিটাল মার্কেটিং সেবাদানকারীদের দ্বারস্থ হতে হবে। এভাবে একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা আরেকটি ব্যবসার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি
প্রতিটি উদ্যোক্তাই এক একজন উদ্ভাবক। এই সময়ের অনেক উদ্যোক্তাই প্রযুক্তি জ্ঞানের দিক থেকে বেশ দক্ষ। তারা নতুন নতুন আইডিয়া উদ্ভাবন করে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছেন। ভেবে দেখুন, গুগল, অ্যামাজন, ফেসবুক কীভাবে সারা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র কুড়ি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে। এখন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবিত নানা সেবা গ্রহণ করে পৃথিবীর মানুষরা ব্যবসা করছে এবং অর্থ উপার্জন করছে।
যখন উদ্যোক্তারা উদ্ভাবক হোন, তখন পুরো পৃথিবীই লাভবান হয়। পৃথিবীর সেরা সেরা উদ্যোক্তারা নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। তাদের কারণে সমগ্র পৃথিবী উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রচলিত ব্যবসা বদলে যাচ্ছে
যখন ব্যবসা বড় হয়ে যায় এবং পুরনো হয়ে যায় তখন সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্রমশ অচল হয়ে পড়ে। তাদের পরিচালন পদ্ধতিতে আমলাতন্ত্র ভর করে। কর্মীরা পুরনো হয়ে যায় এবং দক্ষতা হারাতে থাকে। তারা নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারে না। এক কথায় তারা আকৃতিতে বড় হয়, ধীর গতিসম্পন্ন হয় এবং সক্ষমতা হারায়।
অপরদিকে তরুণরা প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোক্তা হোন। তারা সময়ের সঙ্গে খুব দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। সময়ের চাহিদা বুঝে ব্যবসার ধরণও পাল্টে ফেলতে পারেন। তাই বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তরুণ ও উদ্ভাবনী মেধাসম্পন্ন কর্মী নিয়োগ করা। তাহলে তারাই পুরনো ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকীকরণ করতে পারবে।
আর্থিক ঝুঁকি ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা
যিনি নতুন ব্যবসা শুরু করেন তিনিই কেবল লাভবান হোন, এমন নয়। বরং যারা ব্যবসাটির সঙ্গে যুক্ত থাকেন তারা প্রত্যেকেই উপকৃত হোন। সঠিক উদ্যোক্তা, সঠিক ব্যবসায়িক মডেল ও সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলো লাভবান হতে পারে।
কতিপয় ক্ষতিকর দিক
এতক্ষণ শুধু উদ্যোক্তাবৃত্তির ভালো দিকগুলোই বলা হলো। এর কিছু খারাপ দিকও আছে। যেমন:
উদ্যোক্তা হওয়ার ন্যূনতম আগ্রহ: প্রথম কথা হচ্ছে, উদ্যোক্তা হতে হলে ন্যূনতম আগ্রহ থাকতে হবে। যে ব্যক্তির ব্যবসা করার ন্যূনতম আগ্রহ নেই তিনি যদি উদ্যেক্তা হোন, তবে আর্থিকভাবে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। নেই বললেই চলে। তাই উদ্যোক্তাবৃত্তিতে অনাগ্রহীরা উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করবেন না।
ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি: প্রত্যেক উদ্যোক্তাই সফল হবেন এমন কোনো নিয়ম নেই। পৃথিবীতে বহু উদ্যোক্তার ব্যর্থ হওয়ার নজির রয়েছে। ব্যবসা শুরু করার পাঁচ বছরের মধ্যে সকল পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে এমন উদ্যোক্তাও আছে। সুতরাং ঝুঁকি নিয়েই উদ্যোক্তা হওয়ার পথে পা বাড়ানো উচিত।
যেকোনো সময় সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে: সুন্দর ও স্বাভাবিক গতিতে ব্যবসা চলতে চলতে হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। মালামাল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে এই করোনা মহামারির কথাই বলা যেতে পারে। করোনা এভাবে দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেটা কে ভেবেছিল? এমন পরিস্থিতির জন্য উদ্যোক্তাদের প্রস্তুত থাকতে হয়।
মধ্যমেয়াদী ক্ষতি: ব্যবসা শুরু করার সময় অনেক কর্মীকে নিয়োগ দিতে হয়। তারপর ব্যবসা যখন মধ্যবর্তী পর্যায়ে পৌঁছায় তখন কিছু কর্মীকে ছাঁটাই করার প্রয়োজন হয়। এতে কিছু লোক কাজ হারায়। এটি একটি ক্ষতিকর দিক।
সবশেষে বলতে চাই, অনেক মানুষ শুধু কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন থেকে উদ্যোক্তা হতে চায়। কারণ তারা শুধু টাকাকেই ভালোবাসে। কিন্তু অনেক মানুষ আছেন যারা নিজেদের ভাগ্য বদলানোর জন্য, আশেপাশের মানুষের ভাগ্য বদলানোর জন্য, সমাজকে বদলানোর জন্য, সর্বোপরি দেশকে বদলানোর জন্য উদ্যোক্তা হতে চান। তাই তারা নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন, মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করেন, নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন করেন, সমাজ ও দেশকে পাল্টে দেন। এ ধরনের উদ্যোক্তাকে সহায়তা করার জন্য আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত।
সূত্র: এন্ট্রাপ্রেনার ডটকম
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মারুফ ইসলাম