বার্লিন এবং এক অদ্ভুত প্রাচীর!

বার্লিন এবং এক অদ্ভুত প্রাচীর!

  • আদিবা ইসলাম

একটি প্রাচীর কীভাবে সম্পূর্ণ একটি দেশকে আলাদা করে তার নাগরিকদের দুই ভাগে বিভক্ত করে রাখতে পারে? ভাবতে অবাক লাগলেও এমন ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের ইতিহাস যা আমরা ‘বার্লিন প্রাচীর’ নামে মনে রাখি। চলুন তাহলে আজ শুনে নেওয়া যাক বার্লিন প্রাচীরের গল্প যা শুধু জার্মানিকে ৪০ বছর ধরে দুই দেশে বিভক্ত করে রেখেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে গল্পটা শুরু করা যাক। আমরা সবাই জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মূলত শত্রু এবং মিত্র দেশের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। শত্রুপক্ষ দেশের মধ্যে ছিল জার্মানি, ইতালি এবং জাপান এবং মিত্র দেশ হিসেবে ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর মধ্যে মিত্র পক্ষ এই যুদ্ধে জয় লাভ করে এবং জার্মানি অর্থাৎ শত্রুপক্ষ এ যুদ্ধে হেরে যায়। হিটলারের মৃত্যুর পর মিত্র দেশগুলো জার্মানিকে তাদের দেশের আওতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন ব্যপার হচ্ছে, মিত্র দেশেও তো অনেক আছে, তাহলে কীভাবে জার্মানিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিবে দেশগুলো? তাই জার্মানিকে চার ভাগে বিভক্ত করে পূর্ব জার্মানি সোভিয়াত ইউনিয়নকে এবং পশ্চিম জার্মানি তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেকটি ভাগের এক একটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের কাছে গিয়েছিল। পরবর্তীতে এই তিনটি ভাগকে এক করে দিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে রূপান্তর করা হয়। এখন এই বিভাজনকে যে শুধু রাজনৈতিক বিভাজন বলবেন তা কিন্তু নয়, এটি একটি আদর্শগত বিভাজনও ছিল। পশ্চিম জার্মানি পুজিবাদি মতাদর্শে গঠন করা হয় এবং পূর্ব জার্মানি কমিউনিস্ট মতাদর্শে আধিপত্য বিস্তার করে। এমন কিছু ছিল না যে জার্মান নিজেরা এসকল মতাদর্শে এবং বিভক্তের উপর খুব বেশি প্রভাবিত ছিল। তাদের দেশের এই বিভক্ত অনেকটাই জোরপূর্বক ছিল। 

জার্মানরা দুইটি বিভক্ত অঞ্চলে বসবাস করলেও দুই অঞ্চলের মানুষের প্রায়ই একে অপরের সাথে দেখা হতো। তবে অনেক ব্যক্তি স্থায়িভাবেও অন্য দেশে চলে যাওয়া শুরু করে। এই স্থায়ী অভিবাসন শুধুমাত্র একটি অঞ্চলের মানুষের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। পূর্ব জার্মানি থেকে মানুষ পশ্চিম জার্মানি যেত কিন্তু পশ্চিম থেকে পূর্ব জার্মানিতে ফিরে আসতো না। কিন্তু এমন হতো বা কেন? ইতিহাস ঘাটলেই হয়তো বুঝতে পারবেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা সরকার দ্বারা অনেকটাই কেন্দ্রীভূত ছিল। এর কারণে সরকার কর্তৃক শিক্ষা এবং চিকিৎসা জনগণ পেলেও চাকরির বড়ই সঙ্কট দেখা দেয়। চাকরির অভাব থাকার কারণেই পূর্ব জার্মানরা পশ্চিম জার্মানিতে চলে আসতো। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পূর্ব জার্মানির ২০% জনসংখ্যা যা প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের মতো, পশ্চিম জার্মানিতে চলে যায়। এই ঘটনা অনেকটাই পূর্ব জার্মানির সরকার অনেকটাই বিব্রত হয়ে পড়ে যে কী করে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। তারা চিন্তা করা শুরু করে কীভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। 

পূর্ব জার্মানির এই সমস্যা সমাধানের জন্য সোভিয়াত ইউনিয়ন আমেরিকার তখনকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কাছে পুরো পশ্চিম জার্মানি চেয়ে বসেন। কিন্তু স্পষ্টতই আমেরিকা এই বিষয়ে একটু রাজি হয়নি কারণ এটি তাদের জন্যও লজ্জাজনক হয়ে দাঁড়াত। এসব হতে হতে জুন-জুলাইের শেষ দিকে বিশ্ব বিখ্যাত চলচিত্র উৎসব বার্লিনে অনুষ্ঠিত হয় যেখানে সারা বিশ্বের চলচিত্র নির্মাতারা একত্রিত হন। খুবই আনন্দের সময় কাটলেও সেই সময় গোপনে পূর্ব জার্মানির সরকার একটি প্রাচীর নির্মাণ করতে শুরু করেন। এভাবেই ১৩ই আগস্টে পুরো বিশ্ব জানতে পারে একটি প্রাচীরের কথা যা বার্লিনকে বিভক্ত করে ফেলে। কিন্তু এই প্রাচীর কেউই মেনে নিচ্ছিল না। তারা প্রাচীর বিভিন্নভাবে টপকিয়ে আবারও একত্রিত হতে চাচ্ছিল। কিন্তু সরকার এ ব্যপারে কোনোভাবেই জনগণের ইচ্ছা গ্রাহ্য করছিল না। তারা যেন আরও বাঁধা দিতে শুরু করে যেমন প্রাচীরে কাঁটাতার লাগানো থেকে শুরু করে অনেক কিছু। আসলে এটি একটি রীতিমতো হাস্যকর বিষয় ছিল যে সরকার তাদের সকল প্রকার অর্থ এবং শক্তি শুধু একটি প্রাচীরেই দিচ্ছিল। 

১৯৮০ সাল আসতে আসতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকা দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। এ ছাড়াও সে সকল দেশের বাক স্বাধীনতা বলতেও কিছু ছিল না। এভাবেই শেষমেশ পূর্ব জার্মান সরকার জনগণের চাপে সিদ্ধান্ত নেয় সীমান্তের কঠোর নিয়মকানুন সহজ করে ফেলতে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাথে সাথেই পূর্ব জার্মানির সকল মানুষ সীমানা খুলে আসা শুরু করে। বার্লিন দেয়ালে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করা শুরু করে। এভাবেই জনগণরা মিলে ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে যা একটি ঐতিহাসিক দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।

Sharing is caring!

Leave a Comment