স্ট্যাচু অব লিবার্টির দেশে পড়তে যাই
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ প্রশংসনীয় ও সম্মানজনক বৃত্তিগুলোর একটি ফুলব্রাইট ফরেন স্টুডেন্ট প্রোগ্রাম। ১৯৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর জেমস উইলিয়াম ফুলব্রাইট এই প্রোগ্রাম চালু করেন। সারা বিশ্বের সাড়ে তিন লাখের বেশি শিক্ষার্থী ও গবেষক ফুলব্রাইট প্রোগ্রামে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত ফুলব্রাইট বৃত্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৫৪ জন নোবেল পুরস্কার আর ৮২ জন পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার। গত কয়েক বছরের মতো এবারও বাংলাদেশের আট তরুণ এই বৃত্তি পেয়েছেন।
আটজনই বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন। অফিসের ঝক্কিঝামেলা, গবেষণা, দৈনন্দিন কাজ, শিক্ষকতার ফাঁকে সবাইকে একত্র করাটাই কঠিন। তাই আলাপ-আলোচনাটা মুঠোফোন আর ফেসবুকের মেসেঞ্জারেই সারতে হলো।
তরুণ কূটনীতিক নাসির উদদীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগ থেকে বিবিএ-এমবিএ শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে যোগ দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এ বছর ‘ফুলব্রাইট ফরেন স্টুডেন্ট প্রোগ্রাম’ বৃত্তি পেয়ে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জনের জন্য যাচ্ছেন ভার্জিনিয়ার ওল্ড ডোমেনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশাজীবনে পুরোদস্তুর কূটনীতিক নাসির ৩১তম বিসিএসে ফরেন ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলেন। শুরুতে বনিয়াদি কোর্সে সম্মানজনক রেক্টর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন তিনি। নাসির বলেন, ‘পড়াশোনা ফিন্যান্সে হলেও আমি এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আর কূটনীতি নিয়েই ব্যস্ত। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গুরুত্ব তুলে ধরার কাজটি করছি। ফুলব্রাইট প্রোগ্রাম শেষে বিদেশে পড়ার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমার কর্মক্ষেত্রে দারুণভাবে কাজে লাগবে।’ নাসিরের মতো আরেক সরকারি কর্মকর্তা শিহাব উদ্দিন আহমদ যাচ্ছেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, আলবানিতে। এডুকেশনাল পলিসি ও লিডারশিপ বিষয়ে মাস্টার্স করবেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। ৩০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন। শিহাব বলেন, ‘মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে আমি থানা পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করতে চাই। প্রান্তিক শ্রেণি থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও আধুনিক করার সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে থানা ও গ্রাম পর্যায়ে আমি কাজ করব।’
নিউইয়র্কের সেরাকিউজ ইউনিভার্সিটির নিউহাউজ স্কুলে ম্যাগাজিন, নিউজপেপার অ্যান্ড অনলাইন জার্নালিজমে এক বছর মেয়াদি মাস্টার্সে ফুলব্রাইট বৃত্তি পেয়েছেন কোহিনূর খৈয়াম। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়া শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগে মাস্টার্স করেছেন। পেশাজীবনের শুরুটা হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। ‘সাংবাদিকতা করেছি, কিন্তু এ বিষয়ে তেমন কোনো পড়াশোনা ছিল না। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য সাংবাদিকতাকেই বেছে নিয়েছি আমি।’ এভাবে নিজের আগ্রহের কথা বললেন। আরও জানালেন, ‘ভবিষ্যতে ইচ্ছে আছে সন্ত্রাসবাদ আর লিঙ্গসংক্রান্ত অপরাধবৈষম্য নিয়ে লেখালেখি করার।’
মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) পুরকৌশল বিভাগের প্রভাষক তাহমিদা হোসেন। ফুলব্রাইট প্রোগ্রামের আওতায় টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটি-কলেজ স্টেশনে পড়তে যাবেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএসসি করবেন তিনি। তাহমিদার বক্তব্য, ‘আমার গবেষণার বিষয় ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং। মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি গবেষণায় মন দিতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক জ্ঞানকে বাস্তবের দুনিয়ায় প্রয়োগ ও তার ব্যবহারিক গুরুত্ব নিয়েই আরও কাজ করতে চাই।’ তাহমিদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কমান্ডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি পিএইচডিও করতে চান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষার্থী ছিলেন মো. মাসুদুর রহমান। নিউইয়র্কের ফোর্ড হ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে পড়তে যাচ্ছেন তিনি। পেশাজীবনে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কর্মরত মাসুদ বলেন, ‘ক্রস-বর্ডার বাণিজ্য নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করার ইচ্ছে আছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক ও নানান বিজনেস কমপিটিশনে অংশ নিয়ে পড়াশোনার বাইরে বেশ সক্রিয় ছিলেন মাসুদ। ২০১৩ সালের বিজনেজ কমপিটিশন ব্যাটেল অব মাইন্ডসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রভাষক মাশরুর রহমান। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সপোর্টেশন সায়েন্সে মাস্টার্স করতে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে পিএইচডি করার আগ্রহ থেকে বলেন, ‘আমি গণপরিবহন সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেছি। ভবিষ্যতে ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাই।’ মাশরুরের অর্জনও কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কৃতিত্বের জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পেয়েছেন তিনি।
ওদিকে ফারজানা জাফরিনের কাজ-কারবার মানুষের মন নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে অনার্স ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছেন। তাঁর গন্তব্য ওয়েস্টার্ন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও সাইকোথেরাপি প্রতিষ্ঠান ‘মন’ ছাড়াও নানা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মনোবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছেন তিনি। জানালেন, ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়েই কাজ করবেন। ফারজানার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী এস এম কামরুল হাসান। উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের এই প্রাক্তনী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে আছেন। তিনি কলোরাডো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ অর্থনীতি বিষয়ে মাস্টার্স করতে যাচ্ছেন। কামরুল বলেন, ‘বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এখানে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বড়মাত্রায় গবেষণার সুযোগ আছে। আমি সেই ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে গবেষণায় আগ্রহী হতে চাই।’
ভিনদেশ থেকে পড়ালেখা শেষ করে আটজনই দেশে ফিরে দেশের জন্য কিছু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। লাল-সবুজের পতাকাটার প্রতিনিধি হিসেবে বড় দায়িত্বের কথাও তাঁদের মাথায় আছে।
যেভাবে ফুলব্রাইট বৃত্তির জন্য আবেদন করবেন
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চার বছর মেয়াদি ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং প্রায় দুই বছর কাজের অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, ফুলব্রাইট বৃত্তির জন্য তাঁরা আবেদন করতে পারেন। তবে বয়স হতে হবে ৩২ বছরের কম। অনলাইনের মাধ্যমে বৃত্তির জন্য আবেদন করতে হয়। আবেদনপত্র, সব একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ও সার্টিফিকেটের স্ক্যান কপি জমা দিতে হয় অনলাইনেই। এ ছাড়া লেটার অব রেফারেন্সেরও প্রয়োজন হয়। আর সঙ্গে টোয়েফল (কমপক্ষে স্কোর ৮০) বা আইইএলটিএস (স্কোর ৭.০০) থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য জিআরই/জিম্যাট স্কোর জমা দিতে হয়। সে জন্য ফুলব্রাইট আবেদনে জিআরই/জিম্যাট স্কোরও যোগ করা জরুরি। বছরের এপ্রিল-মে-জুন মাসে এই প্রোগ্রামের জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হয়। ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় বিজ্ঞপ্তি। ফুলব্রাইট ফরেন স্টুডেন্ট প্রোগ্রাম-সংক্রান্ত যেকোনো তথ্যের জন্য ঢাকার আমেরিকান সেন্টারে যোগাযোগ করা যাবে। বিস্তারিত: foreign.fulbrightonline.org ও bd.usembassy.gov/education-culture