ভর্তিযুদ্ধ : সরকারি বনাম বেসরকারি
- নিশাত সরকার
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আজ আমার লেখাটি তাদের জন্য। আমাদের সমাজে একটি ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে শুধুমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেই উচ্চতর বিষয়ে গবেষণা করা যায়। এই ধারণা নিতান্তই ভুল। আর এই ভুলের মাশুল দিতে হয় অনেক শিক্ষার্থীকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে আমরা মনে করি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল বা পিএইচডি করবার স্বপ্নের ওখানেই সমাপ্তি। পারিপার্শ্বিক চাপ সবকিছু মিলিয়ে আমরা ডিপ্রেসড হয়ে পড়ি। কিন্তু বলাবাহুল্য যে, আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান টপ ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং ১০০০-এর মধ্যে নেই। এর কারণ শিক্ষার মানদণ্ডের চেয়ে গবেষণাক্ষেত্রে ফান্ড স্বল্পতাই দায়ী অধিকাংশে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পরবর্তীতে যখন কোনো শিক্ষার্থী বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লিকেশন করেন তখন তার যোগ্যতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিতে যাচাই করা হয় না। বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি, যে বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক না কেন, একজন শিক্ষক ৯০ মিনিটের ক্লাস লেকচারে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরেন। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন যদি থাকে উচ্চতর গবেষণা/পিএইচডি করার তাহলে তার সিলেবাসের বাইরে জ্ঞান অর্জন অতীব জরুরি। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে।
এ ক্ষেত্র আমার গল্পটাই বলি। মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক ফলাফল খুব আহামরি ছিল না। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট বা মেডিকেলে চান্স পাওয়া হয়ে ওঠেনি। আব্বু ঢাকার বাইরে পড়তে দেবেন না বলে শুধুমাত্র ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোথাও ভর্তি পরীক্ষাও দেওয়া হয়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সে সময়টাতে আমার আর কোনো অপশন ছিল না।
সময়টা ছিল ২০০৬। তখন রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল উত্তপ্ত। তাই আমার মা রাজি ছিলেন না, বাসা থেকে খুব দূরে যাতায়াত করতে হয় এমন কোথাও ভর্তি করতে। সম্পূর্ণ অনিচ্ছাতেই স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে ভর্তি হলাম। আমার মা সব সময় বলেন, যেখানে শেষ, সেখানেই শুরু। তাই ডিপ্রেশন বাদ দিয়ে সাবজেক্ট পছন্দ করবার বিষয়ে মনোযোগী হলাম। ইন্টারনেটের কল্যাণে জানতাম যে, বায়োলজিকাল সায়েন্স বিষয়গুলোতে উচ্চতর গবেষণা করবার সুযোগ অনেকটা বেশি।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সে সময়ে দ্বিতীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে মাইক্রোবায়োলজি বিষয়টি পড়ানো হতো। অন্য বিষয়গুলো থেকে এই বিষয়টিতে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কম স্কিলড মানুষ থাকায় এই বিষয়টি বেছে নিলাম। শিক্ষকদের বন্ধুসুলভ ব্যবহারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারার দুঃখটা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম এবং পিএইচডি করার ব্যাপারে মোটিভেটেড হলাম। ডিপার্টমেন্টাল শিক্ষকদের সহযোগিতায় অনার্স ও মাস্টার্সের থিসিস বিসিএসআইরের ল্যাবরেটরিতে করবার সুযোগ হয়েছিল। শিক্ষক ও রিসার্চ সুপারভাইজারদের সহযোগিতায় কাজগুলো জার্নালেও পাবলিশ হয়।
মাস্টার্সের পর দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের জন্য অধ্যাপকদের কাছে ইমেইল করা শুরু করলাম। সৌভাগ্যক্রমে, ইতিমধ্যে আইসিডিডিআরবিতে যক্ষ্মা রিসার্চ ল্যাবে চাকরি পেয়ে যাই এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে প্রমোশনও হয়ে যায়। রিসার্চ পাবলিকেশন, রিসার্চ এক্সপেরিয়েন্স ও IELTS Band score 7 থাকায় ২০১৪ সালের শুরুতে ফুল পিএইচডি স্কলারশিপ পেয়ে যাই অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং পজিশন ৪৭।বর্তমানে আমি গবেষণা করছি Koala retrovirus নিয়ে। আমরা সবাই HIV virus সম্পর্কে কমবেশি অবগত। HIV virus হচ্ছে এক ধরনের retrovirus যা ক্যান্সারের জন্য দায়ী এবং এই ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে এসেছে শিম্পাঞ্জি থেকে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় প্রাণী কোয়ালা ক্যানসার দ্বারা আক্রান্ত এবং ধারণা করা হচ্ছে Koala retrovirus–এর কারণেই এরা ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছে। আমার গবেষণা হচ্ছে এর সত্যতা প্রমাণ করা। কারণ vaccinate করে তা নির্মূল করতে না পারলে মানুষের মধ্যে চলে আসতে পারে HIV virus–এর মতো। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমি আমার পিএইচডি থিসিস সাবমিট করব। পোস্টডক অ্যাপ্লিকেশনগুলো থেকেও ভালো রেসপন্স পাচ্ছি, যেখানে এমন কোনো প্রশ্ন হয়নি যে আমার গ্র্যাজুয়েশন ইউনিভার্সিটি পাবলিক না প্রাইভেট ছিল, বরং প্রশ্ন হয়, ‘তোমার স্কিল সম্পর্কে বল’।
এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় গোল্ডেন ৫ না পেয়ে, স্বনামধন্য সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে না পড়ে আমি যদি ওয়ার্ল্ড টপ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল স্কলারশিপ পেয়ে পিএইচডি করতে পারি, তাহলে অবশ্যই তোমরাও পারবে। শুধু আমি না, আমাদের স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ থেকে অনেকেই জাপান, জার্মানি ও কানাডাতে ফুল স্কলারশিপ পেয়ে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত। তাই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়ার ডিপ্রেশন বাদ দিয়ে ভালো মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করে ক্যারিয়ার গড়ার কাজে মনোযোগী হও। চেষ্টা করলে সাফল্য আসবেই। বিশ্ববিদ্যালয় তোমাকে গাইডলাইন দেবে আর তা কীভাবে ফলো করে ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে তা তোমাকেই নির্ধারণ করতে হবে। আর বাবা-মা তো আছেনই যারা সব সময়ই তোমার পাশে আছেন, থাকবেন।
শুভ কামনা রইল ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য।
নিশাত সরকার: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।