কোরিয়ার ‘এমআইটি’
- সিঞ্চিতা পোদ্দার
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে কোরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলাম ২০১৪ সালে। কোরিয়ান অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (কাইস্ট) স্নাতকোত্তর করছি সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। এখন পর্যন্ত এখানে শিক্ষাজীবনটা দারুণ কাটছে। কাইস্টসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব মিলিয়ে আমরা প্রায় ৯০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছি। আমাদের অভিজ্ঞতা স্বপ্ন নিয়ের পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতেই আজ লিখতে বসেছি। কাইস্ট নিয়ে তো বলবই, তার আগে কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে একটু বিস্তারিত বলা প্রয়োজন।
সাউথ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষার মূল শক্তি হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়া। শিক্ষার মান আর গবেষণার বহুমুখিতাই কোরিয়াকে বিশ্বব্যাপী ছাত্রছাত্রীদের কাছে উচ্চশিক্ষার অন্যতম পছন্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং ২০১৫-এর শীর্ষ ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় কাইস্ট ছাড়াও এখানকার পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আছে।
স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করতে চাইলে: কোরিয়ান স্কুলগুলোতে ফল ও স্প্রিং—এই দুই সেমিস্টারে অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারেন। কোরিয়ায় মাস্টার্স বা পিএইচডি করতে আসা যায় মূলত দুভাবে। প্রথমত, এখানকার একজন অধ্যাপকের গবেষণা সহকারী হিসেবে; দ্বিতীয়ত, কোরিয়ান গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ প্রোগ্রাম বা গ্লোবাল আইটি কোরিয়ান গভর্নমেন্ট স্কলারশিপের আওতায়। প্রথম ক্ষেত্রে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করে নিজের গবেষণার আগ্রহ অনুযায়ী সরাসরি কোনো অধ্যাপকের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করতে হবে। ই-মেইলে থাকতে পারে স্নাতকের সিজিপিএ, আইএলটিএস, টোফেল বা জিআরইর স্কোর, পাবলিকেশন (যদি থাকে), এই নির্দিষ্ট গবেষণায় আগ্রহের কারণ এবং এই ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতার বিবরণ।
সঠিক বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন। সাধারণত কোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বনিম্ন সিজিপিএ ৩.০০ এবং আইএলটিএস স্কোর ৬.০০-কে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। ভালো র্যাঙ্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো সিজিপিএ এবং আইএলটিএস স্কোর চায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে পূর্বশর্তগুলো দেখে এবং নিজের অবস্থান যাচাই করে অধ্যাপককে ই-মেইল করা উচিত।
কোরিয়ান স্কুলগুলোতে অধ্যাপকের সম্মতি ছাড়া ভর্তির সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য। যার আওতায় মোটামুটি পুরো টিউশন ফি মওকুফ হয়ে যায়। কিন্তু এই স্কলারশিপের সংখ্যা সীমিত এবং অগ্রাধিকার পান সেসব ছাত্রছাত্রী, যাঁদেরকে অধ্যাপকেরা তাঁদের গবেষণার সহকারী হিসেবে নিতে চান। ‘রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট’ হিসেবে কাজ করার জন্য যে মাসিক বৃত্তি দেওয়া হয়, তা দিয়ে এখানকার অন্যান্য খরচ বেশ ভালো মেটানো যায়।
কীভাবে আবেদন করব?: কোরিয়ান গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ প্রোগ্রামে (কেজিএসপি) ‘গ্র্যাজুয়েট’ এবং ‘আন্ডারগ্র্যাজুয়েট’ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। নিজ দেশের কোরিয়ান দূতাবাস থেকে অথবা কোরিয়ায় এই প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে নির্বাচিত শিক্ষার্থী হিসেবে সরাসরি আবেদন করা যায়।
কেজিএসপি প্রোগ্রামে প্রথম এক বছর কোরিয়ান ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক। বিস্তারিত: http://bit.ly/1jfn7PL গ্লোবাল আইটি কোরিয়ার গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ প্রোগ্রামে (জিআইকেজিএসপি) সাধারণত মাস্টার্স লেভেলে বৃত্তি দেওয়া হয়। এটিও কোরিয়ান সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। তবে সে জন্য অধ্যাপকের সুপারিশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
স্নাতক করতে চাইলে: কোরিয়াতে ‘আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে’ ভর্তি বেশ প্রতিযোগিতামূলক। এসএসসি, এইচএসসি অথবা ও-লেভেল, এ-লেভেলে খুব ভালো ফলের পাশাপাশি ‘এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি’র সঙ্গে যুক্ত থাকলে সুবিধা হয়। ভালো র্যা ঙ্কের স্কুলগুলোতে ভর্তির জন্য এর বিকল্প নেই বললেই চলে।
লক্ষ্য যখন কাইস্ট: কোরিয়ান অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিকে কোরিয়ার এমআইটি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। কোরিয়ার এই ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলটি এশিয়ায় তৃতীয় সেরা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে বিশ্বের ১৩তম স্কুল হিসেবে স্থান পেয়েছে।
মোটামুটি সব কোর্সই ইংরেজি মাধ্যমের বলে কোরিয়ান ভাষা জানার প্রয়োজন নেই। তবে বাধা নেই শখ করে শেখায়। কাইস্টে ভর্তির আবেদনের নিয়মকানুন কোরিয়ার অন্যান্য ইউনিভার্সিটির মতোই।
গ্র্যাজুয়েট, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট-নির্বিশেষে ভর্তির ক্ষেত্রে সব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর টিউশন ফি কাইস্টের নিজস্ব বৃত্তির আওতায় বিবেচনা করা হয়, যেটা আসলেই প্রশংসনীয়। কারণ, যেখানে আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা বেশ ব্যয়বহুল, সেখানে কাইস্টের মতো ভালো র্যা ঙ্কের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো রকম টিউশন ফি ছাড়াই অনেকে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছেন। বর্তমানে কাইস্টে দুজন গবেষকসহ শিক্ষারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯।
ভবিষ্যতে কাইস্ট এবং কোরিয়ার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আরও বেশি উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান, এই শুভকামনা রইল।