বিদেশে উচ্চশিক্ষা : বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী গমন বেড়েছে ৩৭%
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কিছুদিন কম ছিল। তবে কয়েক বছর ধরেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখিতা বাড়ছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, এক বছরেই উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী শিক্ষার্থী বেড়েছে ৩৭ শতাংশের বেশি।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য নিয়ে প্রতি বছরই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে ইউনেস্কো। সম্প্রতি প্রকাশিত সংস্থাটির ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালে মোট ৩৩ হাজার ১৩৯ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ১১২। এ হিসাবে এক বছরে বিদেশগামী শিক্ষার্থী বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
শিক্ষাবিদদের মতে, দেশে উচ্চশিক্ষা প্রসারের নামে মানহীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। বেশকিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ এসেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান সেভাবে শিক্ষার্থী টানতে পারছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার বিষয়টি। এতে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের বড় অংশই এখন বিদেশমুখী হচ্ছে।
ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালেও উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শীর্ষ গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। বছরটিতে ৬ হাজার ৫৩৪ জন উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। এ হিসাবে ২০১৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশগামী শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশ গেছে মালয়েশিয়ায়। আগের বছর ২০১৪ সালে মালয়েশিয়াগামী শিক্ষার্থী ছিলেন ৫ হাজার ২৭১ জন।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবে মালয়েশিয়াকে বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে নিকটতম দূরত্ব, পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ ও তুলনামূলক কম খরচের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশটিতে বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা থাকাকেও আরো একটি কারণ বলে মনে করেন তারা।
ইউনেস্কোর আগের পরিসংখ্যানে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশীদের তৃতীয় শীর্ষ গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ হিসাবে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে দেশটি। ২০১৪ সালে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে ৪ হাজার ৫৬৫ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমালেও ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৪৪১ জনে। অর্থাৎ এক বছরে দেশটিতে বাংলাদেশী শিক্ষার্থী বেড়েছে ৮৭৬ জন বা ১৯ শতাংশ।
বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে যুক্তরাজ্য। ২০১৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশটিতে পাড়ি জমান ৪ হাজার ৮৬৮ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালেও সংখ্যাটা ছিল একই।
জানা গেছে, ২০১০-১১ সালের দিকে যুক্তরাজ্যে গড়ে ওঠা নামসর্বস্ব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই কয়েক বছর পর বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার। ফলে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হাজার হাজার শিক্ষার্থী সেখানে অবৈধ হয়ে যান। এর পর থেকেই উচ্চশিক্ষায় যুক্তরাজ্য গমন সে হারে বাড়ছে না।
উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শীর্ষ গন্তব্য অস্ট্রেলিয়া। ২০১৫ সালে দেশটিতে পাড়ি জমান ৪ হাজার ৪১৯ জন শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩ হাজার ৯১৫।
নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান মো. আরিফুল হক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের প্রথম সারির কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। সুযোগ না পাওয়ায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সে বিশ্ববিদ্যালয়টিও বিতর্কিত হয়ে পড়ায় পরিবারের সদস্যদের পরামর্শে অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসি।
ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জার্মানিতে। পঞ্চম শীর্ষ গন্তব্য জার্মানিতে ২০১৫ সালে পাড়ি দেন ২ হাজার ৮ বাংলাদেশী শিক্ষার্থী। যদিও ২০১৪ সালে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে দেশটিতে গিয়েছিলেন ৯৯৩ জন। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে জার্মানগামী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ষষ্ঠ শীর্ষ গন্তব্য কানাডা। ২০১৪ সালেও একই অবস্থানে ছিল দেশটি। ওই বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ১ হাজার ৬১৪ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার্থে দেশটিতে পাড়ি দেন। ২০১৫ সালেও সমসংখ্যক শিক্ষার্থী উত্তর আমেরিকার দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন।
এ সময় ভারতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে পাড়ি দিয়েছেন। ২০১৪ সালে মাত্র ৭৭৪ জন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেলেও ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৮ জনে। এ সুবাদে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় অষ্টম থেকে সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে দেশটি।
উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শীর্ষ ১০ গন্তব্যের মধ্যে অষ্টম, নবম ও দশম স্থানে রয়েছে জাপান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০১৫ সালে দেশগুলোয় বাংলাদেশ থেকে পাড়ি দেন যথাক্রমে ৮৭৬, ৭৯৬ ও ৬৪৪ জন শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, একসময় বাংলাদেশে হাতেগোনা কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সীমিত সংখ্যক আসন থাকার ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে বিদেশে পড়তে যেত। কিন্তু পরবর্তীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হয়েছে। এর পর ক্রমান্বয়ে শিক্ষার্থীরা দেশমুখী হয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করে শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের হার ধরে রাখা। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা বিদেশমুখী হবে— এটাই স্বাভাবিক।