বিশ্বসেরা ৩ পোশাক কারখানা বাংলাদেশে
নিউজ ডেস্ক
বস্ত্র ও পোশাক খাতের বিশ্বের সেরা তিন পরিবেশবান্ধব শিল্পের গর্ব এখন বাংলাদেশের। শিল্প তিনটি হলো এনভয় টেক্সটাইল, রেমি হোল্ডিংস ও প্লামি ফ্যাশনস। এর মধ্যে এনভয়ের কারখানাটি ময়মনসিংহে। বাকি দুটি নারায়ণগঞ্জে। সবুজ শিল্প হিসেবে বিশ্বের সেরার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এ তিনটি। এ তিন সবুজ শিল্পে মোট বিনিয়োগ ১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। যার মধ্যে এনভয় টেক্সটাইলের একক বিনিয়োগ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর রেমি হোল্ডিংস ও প্লামি ফ্যাশনসের বিনিয়োগ ১২০ কোটি টাকা করে ২৪০ কোটি টাকা।
বিশ্বে জিনস বা ডেনিম কাপড় উৎপাদন করার প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা হচ্ছে এনভয় টেক্সটাইল। রেমি হোল্ডিংস, সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা এটি। প্লামি ফ্যাশনস, নিট পোশাক তৈরি করা বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা। দেশের বস্ত্র ও পোশাকশিল্পকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠান তিনটি।
রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করার চাপ তৈরি হয়। পরিবেশ রক্ষার তাগিদ অবশ্য তারও অনেক আগের। সেই প্রেক্ষাপটেই তৈরি পোশাকশিল্পের নতুন দিনের যাত্রা শুরু হয়েছে। কর্মপরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় জোর দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের খাতটির উদ্যোক্তা। বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা পিছিয়ে নেই। নতুন নতুন পরিবেশবান্ধব পোশাক ও বস্ত্র কারখানা নির্মিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের এসব পোশাক ও বস্ত্র কারখানা অন্য কারখানার চেয়ে গ্যাস–বিদ্যুৎ–পানিসাশ্রয়ী, কম কার্বন নিঃসরণকারী ও উৎপাদনশীলতা বেশি।
সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে ৩২টি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা আছে। এর মধ্যে ৩০টি হচ্ছে তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও ওয়াশিং কারখানা। নির্মাণাধীন আছে এক শতাধিক পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। এ সনদ পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। ভবন নির্মাণ শেষ হলে কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও আবেদন করা যায়।
ইউএসজিবিসির লিড সনদ পেতে নয়টি শর্ত পরিপালন করতে হয়। যেমন এমন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হয়, যাতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়। এ জন্য পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া ইট, সিমেন্ট ও ইস্পাত লাগে। এ ছাড়া কারখানার ৫০০ বর্গমিটারের মধ্যে শ্রমিকদের বাসস্থান, স্কুল, বাজার, বাস বা টেম্পোস্ট্যান্ড থাকতে হয়। দূরত্ব বেশি হলে শ্রমিকদের গাড়িতে করে কারখানায় আসতে হবে। এতে করে জ্বালানি খরচের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ বেশি হয়। এর বাইরে বিদ্যুৎ খরচ কমাতে সূর্যের আলো, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতি ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি পানিসাশ্রয়ী কল লাগে। এ ছাড়া কারখানাসহ অন্য ভবন নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা রাখার বাধ্যবাধকতা আছে। কারখানার ভেতরের কর্মপরিবেশ উন্নত ও অবশ্যই শ্রমবান্ধব হতে হয়। উৎপাদনের জন্য সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়।
১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউএসজিবিসি। সংস্থাটির অধীনে কলকারখানার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল, বাড়ি, বিক্রয়কেন্দ্র, প্রার্থনাকেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপনা পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়। বর্তমানে বিশ্বের ১৬১টি দেশে লিড সনদ পাওয়া স্থাপনার সংখ্যা ৭৯ হাজার ৬০০ প্রকল্প। এর মাধ্যমে ১৫ হাজার কোটি বর্গফুট জায়গা পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে উঠেছে।
লিড সনদের জন্য নয়টি শর্ত পরিপালনে মোট ১১০ পয়েন্ট আছে। এর মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০–৭৯ পয়েন্টে ‘লিড গোল্ড’, ৫০–৫৯ পয়েন্টে ‘লিড সিলভার’ এবং ৪০–৪৯ পয়েন্ট হলে ‘লিড সার্টিফিকেট’ সনদ মেলে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩০ পোশাক, বস্ত্র ও ওয়াশিং কারখানা লিড সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে প্লাটিনাম ১০ কারখানা, গোল্ড ১৪ কারখানা ও সিলভার ৫টি কারখানা। শুধু সনদ পেয়েছে ১টি কারখানা। কারখানার বাইরেও দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় পরিবেশবান্ধব ছাড়পত্র অর্জন করেছে।
২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব লিড প্লাটিনাম কারখানার ছাড়পত্র পায় ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। ঈশ্বরদী ইপিজেডের এই কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান মৃধা। কুমিল্লা ইপিজেডে শ্রুতি টেক্সটাইল কারখানা লিড গোল্ড সনদ পেয়েছে গত বছর। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদ রাশিদ। গাজীপুরের জেনেসিস ফ্যাশনস ও জেনেসিস ওয়াশিং লিড প্লাটিনাম সনদ পাওয়া কারখানা। এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক আহমেদ। ওসমান ইন্টারলাইনিংস নামের লিড গোল্ড সনদ পাওয়া কারখানাটি ঢাকা ইপিজেডে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সাবরিনা ইসলাম। টঙ্গীতে নর্দান তসরিফা গ্রুপের তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানাটিও লিড গোল্ড সনদ পাওয়া। এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিম হাসান।
বিটপি গ্রুপের দুই কারখানার লিড প্লাটিনাম সনদ আছে—রেমি হোল্ডিংস ও তারাসিমা অ্যাপারেলস। গ্রুপের চেয়ারম্যান রেজা আলী। এসকিউ গ্রুপের তিনটি কারখানা লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে—এসকিউ বিরিকিনা, এসকিউ কোলব্লেনস ও এসকিউ সেলসিয়াস–২। তাদের লিড গোল্ড সনদ পাওয়া কারখানা এসকিউ সেলসিয়াস। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম ফারুক। এনভয় গ্রুপের এনভয় টেক্সটাইল লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে। গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ। চট্টগ্রাম ইপিজেডের রিজেন্সি গার্মেন্টস (ইউনিট–১) লিড গোল্ড সনদ পেয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান। ময়মনসিংহের গ্রিন টেক্সটাইল সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। ময়মনসিংহের এই কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ।
ধামরাইয়ে একেএইচ গ্রুপের একেএইচ ইকো অ্যাপারেলস লিড গোল্ড পাওয়া কারখানা। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। হংকংভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এপিক গ্রুপের ইপিক গার্মেন্টস মেনুফ্যাকচারিং কারখানাটি লিড সিলভার সনদ অর্জন করেছে। কারখানাটি নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডে। একই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আশুলিয়ার পার্ল গার্মেন্টসের লিড সিলভার ও সাভারের কসমোপলিটন ইন্ডাস্ট্রিজের (সিআইপিএল) লিড সিলভার সনদ আছে। লিড প্লাটিনাম সনদ পাওয়া নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনসের কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক।
চট্টগ্রাম ইপিজেডে শ্রীলঙ্কান প্রতিষ্ঠান ইউনিভোগ গার্মেন্টস কোম্পানির কারখানাটি লিড সিলভার মানের। গাজীপুরে ইপিলিয়ন গ্রুপের ইপিলিয়ন স্টাইল কারখানা লিড গোল্ড সনদ পেয়েছে। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন আল–মামুন। গাজীপুরে ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের ইকো কোটার কারখানাটি লিড গোল্ড সনদ অর্জন করেছে। গ্রুপের চেয়ারম্যান ডেভিড হাসনাত। হবিগঞ্জের সায়হাম নিট কম্পোজিট লিড সিলভার সনদ পাওয়া কারখানা। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সাফকাত আহমেদ।
চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী ইপিজেডে শ্রীলঙ্কান প্রতিষ্ঠান কেনপার্ক গ্রুপের চারটি পোশাক কারখানা—কেনপার্ক ২, ৩, ৪ ও ৫ লিড গোল্ড সনদ পেয়েছে। কর্ণফুলী ইপিজেডে আছে শ্রীলঙ্কান প্রতিষ্ঠান হেলা ক্লোথিং লিড গোল্ড সনদ পাওয়া কারখানা। এই ইপিজেডে ভেলটেক্স ইন্টারন্যাশনাল বিডি নামে লিড গোল্ড সনদ পাওয়া বিদেশি বিনিয়োগের কারখানা।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ কমপ্লায়েন্স মেনে আমাদের দেশে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা হয়েছে। বর্তমানে দেড়শটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার নির্মাণকাজ চলছে। এতে করে আমাদের পোশাকশিল্পের প্রতি বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা বাড়বে। ব্যবসাও বাড়বে। অন্যদিকে এসব কারখানা বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির অপচয় বন্ধ ও কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পরিবেশের অনেক উপকার করবে। অবশ্যই এটি একটি বিরাট ব্যাপার।’