ক্ষুরা রোগ ভাইরাসের জীবনরহস্য উন্মোচন
- নিউজ ডেস্ক
ক্ষুরা রোগ ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স বা জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশে ক্ষুরা রোগের যে ভাইরাসগুলো ছড়ায় তার জীবনরহস্য উন্মোচনই শুধু নয়, এ থেকে ভ্যাকসিন তৈরির উপযুক্ত ভাইরাস বীজও সংগ্রহ করেছেন ড. আনোয়ার হোসেন ও তার দল। বাংলাদেশের মত কৃষিভিত্তিক ও পশুপালন নির্ভর দেশে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
বাংলাদেশের গরু-মহিষ পালন করছে শতকরা ৪৫.৯ ভাগ পরিবার। প্রতিটি পরিবারে গড়ে ১.৫ টি গরু-মহিষ রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে মোট জাতীয় উত্পাদনের (জিডিপি’র) প্রায় ২.৯ শতাংশ যোগায় প্রাণিসম্পদ খাত এবং এটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ। আর সরকারি হিসাবে এই ক্ষুরা রোগজনিত কারণে দেশে প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। যা প্রতিবছর বাড়ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুরা রোগের জীবনরহস্য আবিষ্কারকে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক মানছেন সংশ্লিষ্টরা।
আবিষ্কারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বললেন, ‘আমরা এরই মধ্যে দুই সেরোটাইপের ক্ষুরা রোগ ভাইরাসের জীবনরহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকীতে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছি। এছাড়া পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স জিনব্যাংকে জমাও দিয়েছি। আমাদের কাছে এখন ভ্যাকসিন তৈরির উপযুক্ত ভাইরাস বীজ আছে। আমরা আমাদের (অণুজীববিদ্যা বিভাগের) ল্যাবকে আধুনিক করে গড়ে তুলছি যাতে এই ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে পারি।’ তবে তিনি এও বলেন, বাংলাদেশে ক্ষুরা রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সার্বিক সমন্বয়ের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, গবেষণা এখন কোন একক ব্যক্তির কাজ নয়। এককভাবে কাজ করে এই রোগ নির্মূল সম্ভব হবে না।
ড. আনোয়ার হোসেন সমপ্রতি ক্ষুরা রোগের প্রতিষেধক তৈরির জন্য বিশ্ব ব্যাংক হেকেপ- (HEQEP) থেকে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া পার্টনারশিপভিত্তিক গবেষণার জন্য তিন বছর মেয়াদী অনুদান পেয়েছেন, যা শেষ হবে ২০১৮ সালে। এর আগে ২০১১ সালে তিনি প্রথম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প-হেকেপ প্রকল্পের অধীনে সাব প্রজেক্ট হিসাবে এই জীবনরহস্য উন্মোচনের কাজ শুরু করেন। পরবর্তী দুই বছরের গবেষণায় তা সম্পন্ন হওয়ার পর নতুন করে তিন বছর মেয়াদি উপরোক্ত অনুদান লাভ করেছেন।
ক্ষুরা রোগ নির্মূল জরুরি যে কারণে
ক্ষুরা রোগের ভাইরাসটি অতি-সংক্রামক বলে রোগটি দ্রুত ছড়ায়। এ রোগ থেকে গবাদিপশু সেরে উঠলেও অসুস্থ হওয়ার ফলে সেই পশু দিয়ে জমি চাষের ক্ষমতা যেমন কমে যায়, তেমনি তা থেকে মাংস ও দুধ উৎপাদনের ক্ষমতাও হ্রাস পায়। শুধু তাই নয়, এ রোগ থাকলে বিদেশে পশুজাত পণ্য রপ্তানির অনুমোদনও পাওয়া যাবে না। কারণ ওআইই (ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ) এবং ফাও (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা)-এর একটি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা অনুসারে কোন এফএমডি ভাইরাস (ক্ষুরা রোগ) সংক্রমিত এলাকা থেকে বহির্দেশে পশুজাত পণ্য রপ্তানি করা যায় না। তাই বাংলাদেশের পশুখাতে অন্যতম সীমাবদ্ধতা হলো গরুর ক্ষুরা রোগের ভাইরাস সংক্রমণ যা কিনা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করছে।
ড. আনোয়ার হোসেনের গবেষণা
ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশের মানুষের একটা বড় সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছি। সত্যি বলতে ক্ষুরা রোগের গবেষণা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই রোগের ভাইরাস নির্মূল করতে হবে। এটা যেন বংশ বিস্তার করতে না পারে সে লক্ষ্যে সার্বক্ষণিকভাবে দেশের নানা প্রান্ত থেকে নমুনা সংগ্রহ এবং ভ্যাকসিন (টিকা) তৈরি করতে হবে। এভাবে ধারাবাহিক কাজের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশকে ক্ষুরা রোগ এবং ভ্যাকসিন ফ্রি দেশে পরিণত করতে পারবো। তখন আমরা বিদেশের বাজারে মাংস রফতানির অনুমতি পাবো। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘খুব শিগগির আমরা ক্ষুরা রোগের প্রতিষেধক মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারবো। সে পরীক্ষা সফল হলে খুব দ্রুত কৃষক ও খামার পর্যায়ে ভ্যাকসিন পৌঁছানো যাবে।
আনোয়ার হোসেন জানান, ক্ষুরা রোগের সাতটি সেরোটাইপ (ভিন্ন ভিন্ন ধরন) থাকলেও বাংলাদেশে টাইপ এ, ও এবং এশিয়া ১ পাওয়া যায়। মাইক্রোবিয়াল জেনেটিক্স এন্ড বায়োইনফরমেটিক্স ল্যাবরেটরির রোগতত্ত্ব গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ক্ষুরা রোগের সেরোটাইপ ও-এর বিস্তার সবচেয়ে বেশি: ৮০-৮৫%, সেরোটাইপ এ ১০-১৫% এবং এশিয়া ১ এর বিস্তার ০-৫%। তিনি বলেন, এশিয়া ১ বাংলাদেশে বেশ দুর্লভ। এমনকি এটি আমাদের দেশে নাও থাকতে পারে, থাকলেও তা যশোর বা গাজীপুরের মতো নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ক্ষুরা রোগের বিরুদ্ধে লড়তে প্রয়োজন যথার্থ প্রতিষেধক টিকা। কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষুরা রোগের টিকা মূলত আমদানি হয় ভারত থেকে। সমস্যা হলো, ভারতীয় টিকাগুলো যে সকল ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে, আমাদের দেশে সে ভাইরাসগুলো একই টাইপের হলেও এদের মধ্যে বংশগতীয় ভিন্নতা যথেষ্ট। এ কারণে ভারতীয় প্রতিষেধক টিকা বাংলাদেশি গরুতে প্রয়োগ করা হলেও তাদের মধ্যে ক্ষুরা রোগের বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধ শক্তি পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয় না। এছাড়াও আমদানিকৃত প্রতিষেধক ট্রাইভ্যালেন্ট (অর্থাত্ একই সঙ্গে তিনটি সেরোটাইপের ক্ষুরা-রোগ ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করার কথা এ প্রতিষেধকটির) টিকার খরচও বেশি। যেহেতু বাংলাদেশে টাইপ ও এবং এ ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে, কাজেই বাইভ্যালেন্ট (দুটির বিরুদ্ধে) প্রতিষেধক তৈরি করলেই তা যথেষ্ট হওয়ার কথা।
তিনি বলেন, মাইক্রোবিয়াল জেনেটিক্স অ্যান্ড বায়োইনফরমেটিক্স ল্যাবরেটরির একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, একটি গরুতে ক্ষুরা রোগের এশিয়া ১ সেরোটাইপ ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা দেয়ার পরেও তা আবারো এশিয়া ১ সেরোটাইপের এফএমডি দিয়ে আক্রান্ত হয়েছে। ফলে এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, বিদেশ থেকে আমদানি করা টিকা দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষুরা রোগের সংক্রমণ বন্ধ করা যাবে না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে নিজেদের প্রতিষেধক তৈরি করতে হবে। কী ধরনের প্রতিষেধক তৈরি করা হবে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মতামতও নেয়া প্রয়োজন।
এফএমডি বা ক্ষুরা রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে ক্রমাগত ভাইরাসটি বদলে যাওয়ার কারণে এক সময় ভ্যাকসিনটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাই প্রচলিত রীতি হলো নিয়মিত ক্ষুরা রোগের ভাইরাস নমুনা সংগ্রহ করে তার বংশগতি উপাদানের পরিবর্তনের খবর রাখা ও ভাইরাসটি পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন ভ্যাকসিন তৈরি করা। ঠিক এ লক্ষ্যেই কাজ করছেন ড. আনোয়ার হোসেন ও তার গবেষণাদল।
ক্ষুরা রোগটা আসলে কী
যে সকল রোগ গবাদি পশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় তার মধ্যে ক্ষুরা রোগ সবচেয়ে মারাত্মক। গবাদি পশুর ক্ষুরে আর মুখে হয় বলে ইংরেজিতে ক্ষুরা রোগকে ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ (এফএমডি) বলা হয়। দ্বি-খণ্ডিত ক্ষুর আছে এমন যে কোনো প্রাণীর দ্বারাই এটি সংক্রামিত হতে পারে। এই রোগের আক্রান্ত পশু থেকে চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থানকারী পশুও সেই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত পশুর প্রচণ্ড জ্বর হয়। পশুর মুখ ও নাক দিয়ে লালা ঝরতে থাকে। মুখের ভিতর ছোট ছোট পানির ফোস্কা পড়ে। ফোস্কাগুলো পরে মিশে গিয়ে বড় ক্ষত বা ঘায়ের সৃষ্টি করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে আক্রান্ত পশুর ক্ষুর ও চামড়ার সংযোগ স্থলে ফোস্কা ঘা হয়। মনে হয় যেন ক্ষুরটা খসে পড়েছে।
এই রোগে বড় গরুর মৃত্যুর হার কম হলেও বাছুরের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার শতকরা ৭০ ভাগ পর্যন্ত দেখা গেছে। আর সঙ্কর জাতের গরুতে এই রোগের সংক্রমণ অত্যন্ত বেশি। বড় গরুর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দুগ্ধবতী গাভী এই রোগে আক্রান্ত হলে দুধ কমে যায়। অনেক গাভী বন্ধ্যা হয়ে যায়। সেই গাভীর কর্মক্ষমতাও থাকে না।
সব ঋতুতে দেখা গেলেও শীত ও বর্ষা ঋতুতে ক্ষুরারোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
বাংলাদেশে ক্ষুরা রোগের পরিস্থিতি
গবেষণায় জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষ করে ভারত, মায়ানমার, নেপাল ও ভূটান থেকে ক্ষুরা-রোগের বিভিন্ন ভাইরাস বাংলাদেশে এসে ঢুকছে। এ কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুরা-রোগের ভাইরাসের একটি সংমিশ্রণ আধার হিসেবে কাজ করছে। ফলে সার্বিকভাবে ক্ষুরা রোগ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি দেশকে ক্ষুরা রোগমুক্ত করতে হলে পাঁচটি ধাপ পেরোতে হয়। বাংলাদেশ সেই ধাপের সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০১৫ সালে প্রথম ধাপে উন্নীত হওয়া। প্রথম ধাপটি হচ্ছে সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও প্রতিকারের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ। সেই ধাপে ২০১৩ সালেই ড. আনোয়ার হোসেনের গবেষণা বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু এরপর আর অগ্রগতি নেই।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ২০১৫ সালে এসে উপমহাদেশে বাংলাদেশ এই অর্জনে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে ভুটান। আফগানিস্তান রয়েছে ৩য় ধাপে। ভারত ৪র্থ, নেপাল ২য়, পাকিস্তান ২য় এবং শ্রীলঙ্কা ৩য় ধাপে।
ড. আনোয়ার হোসেন তার গবেষণাগারে বর্তমানে ক্ষুরা-রোগের সম্পূর্ণ ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয়করণের মাধ্যমে রিভার্স-জেনেটিক্স পদ্ধতিতে রিকম্বিনেন্ট ভাইরাস ও পেপটাইড প্রতিষেধক তৈরির কাজ করছেন। এছাড়াও মাঠপর্যায়ে ক্ষুরা-রোগের ভাইরাস দ্রুত শনাক্তকরণের জন্য কিটও তৈরি হচ্ছে।
তার গবেষণাদলে আরো চারজন শিক্ষক, একজন পোস্ট ডক্টরেট গবেষক, তিনজন পিএইচডি করা গবেষক, বেশ কয়েকজন এমএস ছাত্র ও একজন টেকনিশিয়ান যুক্ত আছেন।