যে দেশে তরুণরাই সম্পদ
- নিউজ ডেস্ক
তরুণেরাই এখন বাংলাদেশের সম্পদ। দেশের এক–চতুর্থাংশ মানুষের বয়স এখন ১৫ থেকে ২৯ বছর। এমন বয়সী তরুণ–তরুণীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ১৭ লাখ। তাঁদের অর্ধেকই পড়াশোনা করছেন। বাকি তরুণেরা শ্রমবাজারে এসে চাকরি বা কাজ করছেন। পড়াশোনা করে যাঁরা শ্রমবাজারে এসেছেন, তাঁদের অনেকেই নিজেদের পছন্দমতো চাকরি বা কাজ পাননি। অনেকটা বাধ্য হয়েই তাঁরা চাকরি করছেন।
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৫ লাখ তরুণ–তরুণী এখন বেকার। বাংলাদেশে যত বেকার আছেন, তাঁদের প্রতি চারজনের তিনজনই বয়সে তরুণ।
বিবিএসের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৫ থেকে যুবসমাজের এ চিত্র পাওয়া গেছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে সোয়া পাঁচ কোটি শিশু–কিশোর আছে, যাদের বয়স ১৪ বছরের নিচে। আগামী দেড় দশকজুড়ে তারা শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে। এর মানে হলো, ভবিষ্যতে শ্রমশক্তিতে যুবসমাজের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।
যুবশক্তি: বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে শ্রমবাজারে আছে ৬ কোটি ১৪ লাখ জন। তাঁদের সবার বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছর। এ বিশাল শ্রমবাজারে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ২ কোটি ৩ লাখ ৮৬ হাজার তরুণ–তরুণী আছেন। শ্রমবাজারের এক–তৃতীয়াংশই তরুণ। তাঁদের মধ্যে চাকরি বা কাজ করছেন ১ কোটি ৮৪ লাখ ৪৭ হাজার। বাংলাদেশে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ।
চাকরি বা কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে তরুণীদের চেয়ে তরুণদের সুযোগ অনেক বেশি। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে নারী–পুরুষ সমান হলেও কাজের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ সুযোগ পান তরুণেরা। দেশে ১ কোটি ২৪ লাখ তরুণ কাজ করেন। অন্যদিকে তরুণীদের সংখ্যা মাত্র ৬০ লাখ।
শিক্ষিতরাই বেশি বেকার: লেখাপড়া করে যে, গাড়ি–ঘোড়া চড়ে সে—প্রায় সবাই এ প্রবাদবাক্যটি শুনেছেন। বাস্তব চিত্র কিন্তু ভিন্ন। শিক্ষিত তরুণ–তরুণীরা বেশি বেকার। এমন একজন বেকার হলেন জুলফিকার আলী। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজিতে এ বছর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। সেশনজটের কারণে উচ্চমাধ্যমিকের পর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে লেগে গেছে আট বছর। চাকরির জন্য সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিলেও মেলেনি প্রত্যাশিত চাকরি। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় ভুগতে থাকা জুলফিকার বলেন, ‘কী করব বুঝতে পারছি না। চাকরি না পেলে অন্য কী কাজ করব, সেই হিসাব মেলাতে পারছি না।’
মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশে পড়াশোনা না করলেই বরং কাজ পাওয়ার সুযোগ বেশি। বিবিএস বলছে, পড়াশোনার সুযোগ না পেয়ে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী লোকদের মধ্যে বেকার মাত্র দেড় লাখ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে এখনো অদক্ষ ব্যক্তিদের আধিপত্য বেশি।
তবে আশার কথা হলো, সরকারি–বেসরকারি চাকরির পেছনে না ছুটে তরুণদের মধ্যে এখন অনেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন। এমন একটি সফল উদাহরণ হলো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করা রাইসুল কবির। স্নাতক পাস করার পর নিজ উদ্যোগে মাত্র ২৩ বছর বয়সে একটি স্টার্ট আপ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান খোলেন তিনি। ১০ বছর আগে শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানে এখন তাঁর অধীনে কাজ করেন ১২০ জন কর্মী। রাইসুল কবির বলেন, ‘অনেক বন্ধুর মতো চাইলে আমিও স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যেতে পারতাম। তবে আমার ইচ্ছা ছিল দেশে থেকেই নিজে যেন কিছু করতে পারি। নিজের ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের জোরে এত দূর এসেছি।’
অনেক তরুণ এখন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরিও করছেন। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত তাসনিয়া লসকর পড়াশোনার পাশাপাশি একটি বেসরকারি রেডিও স্টেশনে কথাবন্ধু হিসেবে কাজ করেন। এর সঙ্গে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রদায়ক হিসেবেও তিনি কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আমার আগ্রহ। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখি।’
পরিকল্পনা: সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১ কোটি ২৯ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মাসে এ কর্মসংস্থান হবে। পরিকল্পনায় আরও বলা হয়েছে, এ সময়ে ৯৯ লাখ তরুণ–তরুণী শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে। তাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে ওই পরিকল্পনায়।
এদিকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর জাতীয় যুবনীতির খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এ খসড়ায় যুবকদের কর্মসংস্থানকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এ খসড়া নিয়ে বিভিন্ন মহলের মতামত নিতে শুরু করেছে।
জনসংখ্যাতাত্ত্বিক এ সুবিধাকে অর্থনৈতিক সুযোগে পরিণত করতে তরুণদের কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ এ কে এম নুরুন নবী। তাঁর মতে, এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি সেই অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। প্রচলিত শিক্ষার বাইরে যাঁর মধ্যে যে ধরনের সম্ভাবনা আছে, তাঁকে ওই কাজে প্রশিক্ষিত করতে হবে। তিনি আরও উদাহরণ দেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে কেমন লোক দরকার—এ নিয়ে একটি সমীক্ষা হওয়া জরুরি। পরে সেই সমীক্ষা ধরে এ দেশের তরুণদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। এ ছাড়া সারা বিশ্বে আউটসোর্সিংয়ের বাজারের আকার ৫০ হাজার কোটি ডলার। এ খাতেও যুবসমাজকে প্রশিক্ষণ দিলে দেশে বসেই বিপুল অর্থ উপার্জন করতে পারবে।
জনসংখ্যা বোনাস: তরুণ জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের জন্য সুখবর রয়েছে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনে। চলতি বছরের এপ্রিলে জনমিতির পরিবর্তন নিয়ে করা ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখন ১০ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ কর্মক্ষম, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৬ শতাংশ। তাঁদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছর পর্যন্ত। সংস্থাটির মতে, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা গিয়ে পৌঁছাবে ১২ কোটি ৯৮ লাখে, যা হবে তখনকার মোট জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। এ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ থাকবে তরুণ। জনমিতির এ সুফল কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কর্মক্ষম এ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাই বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

 
	                
	                	
	            
 
	                       			                       	 
	                       			                       	 
	                       			                       	 
	                       			                       	