‘এ’ কার্ডে লাঘব ফরিদপুরের কৃষকের দুশ্চিন্তা
- নিউজ ডেস্ক
ফরিদপুর সদর উপজেলার হাট গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক মো. আবুল বাশার। চলতি আমন মৌসুমের শুরুতে সার কেনার টাকা জোগাড় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তিনি। এমন সময়ে আশীর্বাদ হয়ে এল ‘এ’ কার্ড। কৃষকদের জন্য বিশেষ সুবিধায় দেয়া কার্ডের ১০ হাজার টাকা দিয়ে সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ কিনে জমিতে ধান আবাদ করেন তিনি। এ ধান তার গোলায় উঠছে কিছুদিনের মধ্যেই। ফসল ঘরে তোলার আগে বিক্রেতাও ঠিক হয়ে গেছে। ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করে এ ঋণের টাকা পরিশোধের পরিকল্পনা করছেন তিনি। আবাদ মৌসুমের শুরুতে অর্থায়ন থেকে শুরু করে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে আবুল বাশারের মতো ফরিদপুরের প্রায় এক হাজার কৃষকের দুশ্চিন্তা লাঘব করেছে ‘এ’ কার্ড। কৃষি উপকরণ কেনা থেকে শুরু করে পণ্য বিপণনে কার্ডটির সুফল ভোগ করছেন তারা। জানা গেছে, আগামী পাঁচ বছরে কার্ডটির সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা হবে আরো ৫০ হাজার কৃষককে।
‘এ’ কার্ডের উদ্ভাবন ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়েছে ইউএসএআইডির কৃষি সম্প্রসারণ সহযোগিতা কার্যক্রম (এইএসএ) প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন। প্রকল্পের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্যাংক এশিয়া। কার্যক্রমের সহযোগী হিসেবে রয়েছে কেয়ার বাংলাদেশ, এমপাওয়ার ও এমস্টার-এফএইচআই৩৬০। ফরিদপুরে প্রকল্পের বেসরকারি সহযোগিতা সংস্থার (এনজিও) দায়িত্ব পালন করছে সোসাইটি ডেভেলপমেন্ট কমিটি (এসডিসি)।
জানা গেছে, প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমেই কৃষক এবং শস্য ও কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হয়। কৃষককে সংগঠিত করে গঠন করা হয় কৃষি উৎপাদক দল। দলের প্রত্যেক সদস্যকে ব্যাংক এশিয়ার একটি করে ডেবিট কার্ড দেয়া হয়। কার্ডটির মাধ্যমে কৃষকদের প্রত্যেককে ঋণ দেয়া হয় ১০-২০ হাজার টাকা। কৃষি উৎপাদক দলগুলোকে দেয়া হয় প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে ছয়টি বিশেষ পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোযোগী হন উৎপাদক দলের কৃষকরা। পাশাপাশি কৃষিপণ্য সরবরাহকারীদেরও চিহ্নিত করে এ যৌথ প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা হয়। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে বিভিন্ন পর্যায়ে ক্রেতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে কাজ করেন এসব সরবরাহকারী। জানা গেছে, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে শুধু কৃষির জন্য ঋণ দেয়া হয়। উপকরণ সরবরাহকারীদের এ কার্যক্রমে সংযুক্ত করায় কৃষকের জন্যও এ অর্থ কৃষির বাইরে অন্য খাতে খরচের সুযোগ নেই।
আবুল বাশার বলেন, প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতে সার ও সেচের অর্থ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতাম। কিন্তু এ দুশ্চিন্তা এখন আর নেই। আগে ফসল আবাদ শুরু হলে নকল ও মানহীন উপকরণ কিনে প্রতারিত হতে হতো। এ মৌসুমে সেটিও হয়নি। ধান কাটা শুরু হয়েছে। এখন উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারলে বলা যাবে, গোটা প্রক্রিয়াতেই পরিবর্তন নিয়ে এসেছে ‘এ’ কার্ড।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘এ’ কার্ডের মাধ্যমে প্রয়োজনের সময় অর্থ জোগাড় করতে পারছেন কৃষক। অন্যদিকে ফসল ঘরে তোলার পর তা ন্যায্যমূল্যে বিক্রিরও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ‘এ’ কার্ড। ফলে শস্য বিক্রির টাকা দিয়ে শুরুতে নেয়া অর্থ সহজেই পরিশোধ করতে পারবেন তারা। এমনকি এতে কৃষকের বাড়তি সঞ্চয়েরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কার্যক্রমে প্রকল্পভুক্ত কৃষককে সঠিক তথ্য, স্বল্পমূল্যে কৃষি উপকরণ ক্রয় ও লাভজনক মূল্যে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রির সুযোগ করে দেয়াসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেবা দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। ফলে কৃষক ও অংশীজনের মধ্যে কার্ডটি নিয়ে সাড়া সৃষ্টি হয়েছে। আবার দল গঠন করে কৃষকদের সংগঠিতও করা হচ্ছে। ফলে সঞ্চয়ের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতাও বিনিময় করতে পারছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এইএসএ প্রকল্পের চিফ অব পার্টি বিদ্যুত্ কুমার মহালদার বলেন, উন্নত চাষাবাদ ও কৃষির অর্থনৈতিক সাফল্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজন আর্থিক সেবাগুলোয় কৃষকের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাংকিং সুযোগের বাইরে থাকা ক্ষুদ্র কৃষকরা ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারছেন। তারা ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিচ্ছেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু ঋণ নয়, সঞ্চয়ের সুযোগও পাচ্ছেন কৃষক। কৃষকের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি এ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়টিকেও আরো সহজ করে আনা হচ্ছে।
জানা গেছে, কার্যক্রমের আওতায় কার্ডের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের সুদ নেয়া হয় ১০ শতাংশ হারে। কার্যক্রমে উপকরণ ব্যবসায়ী নির্ধারণ করে দেয়ায় গুণগত মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ কেনায় কোনো সমস্যায় পড়ছেন না কৃষকরা। একই সঙ্গে এ ঋণ ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধযোগ্য হওয়ায় এতে কিস্তির ঝঞ্ঝাটও নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা যায়, পাইলট প্রকল্প হিসেবে ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে ‘এ’ কার্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বর্তমানে এক হাজার কৃষকের মধ্যে প্রকল্পটি চলমান থাকলেও জেলার আরো প্রায় আড়াই হাজার কৃষককে এ কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ফরিদপুরে কার্ডের কার্যক্রমের সফলতার ওপর ভিত্তি করে যশোর ও খুলনা জেলায়ও ‘এ’ কার্ডের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হবে। এভাবে ২০১৮ সালের মধ্যে ১০ হাজার ও ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ হাজার কৃষককে এ কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
কৃষিতে ‘এ’ কার্ডের সুফল প্রসঙ্গে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আহসান উল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য যেমন কমানো সম্ভব হয়েছে, তেমনি ভোক্তাদের ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনারও নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষি উপকরণ বিক্রেতারা এত দিন যে অস্বাভাবিক মুনাফা ও মানহীন পণ্য বিক্রির মাধ্যমে কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা করত, ‘এ’ কার্ডের মাধ্যমে সেটিও প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে।