মাছ চাষে নীরব বিপ্লব
- নিউজ ডেস্ক
‘মাছে ভাতে বাঙালি’র সঙ্গে বাংলাদেশের জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব অনেককাল ধরেই। আগে খেতে বসলে পাতে মাছ থাকবে না তা যেন ভাবাই যেত না। বাঙালির মৎসগত প্রাণ। এক সময় বাংলাদেশ ছিল মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ছিল বাঙালির পরিচয়। কালক্রমে সেই দিন হারিয়ে যেতে থাকে। ক্রমশ মাছে ভাতে বাঙালি প্রবাদটি ‘ডাল-ভাতে’ এসে ঠাঁই নেয়। এখন দেশে আবার সুদিন ফিরেছে মাছের। দেশের মৎসবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত জাতের মাছ চাষে এগিয়েছে। বর্তমানে মত্স্য উত্পাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে বাংলাদেশ। ‘মৎস মারিব খাইব সুখে’-র মেজাজটা যেন অনেকটা ফিরে এসেছে। নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে মিঠা পানির মাছ চাষ। বাণিজ্যিক মাছ চাষে নিরব বিপ্লব ঘটেছে দেশে। বাংলাদেশ এখন মাছ উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেশি মাছ। ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ। কারেন্ট জালসহ নিত্যনতুন পদ্ধতিতে মাছ নিধন, কীট নাশক প্রয়োগে বেপরোয়াভাবে মাছ নিধন, জলাশয় ভরাট করে আবাসন গড়া, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, বাঁধ দিয়ে মত্স্য চাষ, অবাধ ড্রেজিং বাণিজ্য, বিদেশি লাভজনক আগ্রাসি মাছের চাষ প্রভৃতির ফলে দেশি মাছ শূন্য হওয়ার পথে।
এদিকে গ্রামে গ্রামে বেকার তরুণদের অনেকে মাছ চাষে ঝুঁকছেন। তারা বাণিজ্যিকভাবে উত্পাদন করছেন মাছ। কেবল পুকুর-ডোবা নয়, চৌবাচ্চাতেও চাষ করা যাচ্ছে মাছের। সরকারি এক হিসাবে ইতোমধ্যে দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস খাতের উপর নির্ভরশীল।
জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে মিঠা পানির মাছ উত্পাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এফএওর হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের ৫৭ শতাংশ শুধু মাছ থেকেই মেটানো হয়। দেশের জনসাধারণের আমিষের চাহিদাপূরণ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচনসহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মত্স্যসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গত তিন দশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মাছ চাষে উত্পাদন ২৫ গুণ বেড়েছে এবং মাছ চাষিরা তাদের উত্পাদিত মাছের ৭৫ শতাংশ এখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করছেন। বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ ও সমুদ্র থেকে আহরণ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন বেড়েছে।
মত্স্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুয়ায়ী, গত বছর দেশে ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে চাষ করা মাছ ২৫ লাখ টন এবং প্রাকৃতিকভাবে ১৬ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বলছে, আগামী ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করবে, তার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। এরপরই আছে থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের নাম। মাছ উত্পাদনে শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় মিয়ানমারও এগিয়ে আসছে। শুধু দেশ নয়, বিদেশের চাহিদা মেটাতেও এখন মাছ রফতানি করছে বাংলাদেশ।
গত ৩ মে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থ বছরের গত ১০ মাসে মাছ রফতানি করে ৪৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। গত বছর একই সময়ে মাছ রফতানি করে আয় হয়েছিল ৪২ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের মত্স্যবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত মাছের জাত এবং তা দ্রুত সমপ্রসারণের ফলে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, গাজীপুর, যশোর, বগুড়া ও কুমিল্লা জেলায় পুকুরে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ঘেরে মাছ চাষের ফলে এই অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশের মৎস খাত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্প জাতীয় মাছের চাষ ও পোনা অনেক দিন ধরেই উৎপাদন হচ্ছে। দেশের স্বাদু পানির মাছের মধ্যে শিং, মাগুর এবং কই মাছের চাষ অনেক দিনের। উৎপাদনও প্রচুর। আগে শুধু ‘থাই কই’ চাষ হতো। কয়েক বছর ধরে ভিয়েতনামের কই চাষ হচ্ছে। এগুলো দেখতে আকারে ও রঙে দেশি কইয়ের মতো। এছাড়া সমপ্রতিক বছরগুলোতে বাটা, সরপুঁটি, টেংরা, পাবদা, গুলশা, শোল, মহাশোল ও টাকি মাছের চাষ ও পোনা উৎপাদন হচ্ছে। খলশে ও রয়না বা ভেদা মাছেরও স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে। আরো কিছু নতুন মাছের চাষ চলছে।
মৎস অধিদপ্তরের তথ্য মতে গত কয়েক দশকে দেশে চাষ করা মাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। শিং, মাগুর, পাবদার মতো আরও বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ হারিয়ে যেতে বসেছিল। গবেষণার মাধ্যমে এই জাতের মাছ এখন চাষ হচ্ছে। চাষ করা মাছ থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ উত্পাদন হয়। দেশে বিপুল পরিমাণ পাঙাশ, তেলাপিয়া ও রুইজাতীয় মাছের উত্পাদন বেড়েছে। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীনের উদ্ভাবিত মাছের জাত এখন বাংলাদেশের মৎস উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশের টিম লিডার আবদুল ওহাব মনে করেন, শিক্ষিত তরুণেরা চাকরির দিকে না ঝুঁকে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো মাছ ও কৃষিকাজে সহজ শর্তে ঋণ দিয়েছে। এতে মাছের দিকে মানুষ ঝুঁকেছে। বাজারে মাছের ব্যাপক চাহিদাও মাছের উত্পাদন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
মৎস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের স্বাদু পানিতে ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ ছাড়া খাঁড়ি অঞ্চল ও লোনা পানিতে কয়েকশ’ প্রজাতির মাছ আছে। এর মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভারকার্প, গ্রাসকার্প, কালিবাউস, সরপুঁটি, নাইলোটিকা, পাঙ্গাশ ইত্যাদির চাষ হচ্ছে পুকুর, খাল, ডোবা ও ঘেরে। এর পাশাপাশি পাবদা, গুলশা, তেলাপিয়া, কই, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, টেংরা মাছ ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। বাজারে অবশ্য এসব মাছেরই সরবরাহ বেশি। মত্স্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে যে মাছ উত্পাদন হয়েছে, তার ৫৬ দশমিক ৮২ শতাংশ বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে চাষের মাধ্যমে। ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ মাছ এসেছে সমুদ্র থেকে। আর ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ মাছ উত্পাদন হয়েছে দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়ে। মানুষের কাছে প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছের চাহিদা বেশি। তবে বাজারে দেশীয় মাছের প্রাচুর্য কম। চাষের মাছে সয়লাব। চাষ করা কই প্রতি কেজি একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকায় মিললেও খাল-বিলে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা মাছ যাকে সবাই ‘দেশি’ মাছ বলে থাকে সেই কইয়ের দাম প্রতি কেজি ন্যূনতম ৫০০ টাকা। নদীর পাঙ্গাশ হলে দাম চাষের পাঙ্গাশের তুলনায় কয়েক গুণ। অস্তিত্ব সংকটে পড়া দেশি মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে: কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, চাপিলা, শৈল, টাকী, গজার, বোয়াল, বাইলা, মেনি, বাইন, কাচকি, গোদা চিংড়ি, চাঁন্দা, চিতল ইত্যাদি। এসব মাছ রাজধানীর বড় বড় বাজারে পাওয়া গেলেও দাম অনেক।
মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, মাছে ভাতে বাঙালি এই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য আবার পুনরুদ্ধার হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী একজন মানুষের দিনে অন্তত ৬০ গ্রাম মাছ খাওয়া প্রয়োজন। আর একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ১২০ গ্রাম মাংসের প্রয়োজন। দেশে বর্তমানে দৈনিক মাথাপিছু মাংসের প্রাপ্যতা ১২১ দশমিক ৭৪ গ্রাম, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। ফলে চাহিদা অনুযায়ী মাংস উত্পাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর বাংলাদেশ এখন মৎস উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মন্ত্রী বলেন, চাষের মাছে দেশে বিপ্লব ঘটেছে। তেলাপিয়া, কই, পাবদা, গুলশা, শিং ও মাগুর মাছের উত্পাদনের ক্ষেত্রে ‘এক নীরব বিপ্লব’ সাধিত হয়েছে।