শিশুর চঞ্চলতাই কি অসুস্থতা ?

শিশুর চঞ্চলতাই কি অসুস্থতা ?

শিমি আক্তার : শিশুর চঞ্চলতার কারণে অনেক বাবা-মা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। মনে করেন অমুকের শিশু শান্ত কিন্তু আমার বাচ্চাটা কেন এত অশান্ত? শিশুদের আচারণের কিছুটা পার্থক্য থাকতেই পারে। চঞ্চলতাই শিশুদের বৈশিষ্ট্য। শিশুরা হাসবে, খেলবে, চঞ্চলতা দেখাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চঞ্চলতার কারণে যদি একটি শিশু অধিক মাত্রায় অমনোযোগী হয়ে উঠে, স্কুল বা বাড়ীর কোনো কিছুতেই মনোসংযোগ করতে না পারে তাহলে সত্যিই এটি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিশুর এ ধরনের আচরণকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ‘অসুস্থতা’ বলে মনে করা হয়। এ ধরণের রোগকে হাইপারকাইনোটিক ডিসঅর্ডার বা অতি অমনোযোগী অথবা অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভ ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি) বলা হয়। এ সময় শিশুটির বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। সাধারণত এ রোগের লক্ষণ ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যেই দেখা দিয়ে থাকে। সবার আগে মা-বাবা, গৃহ শিক্ষক বা স্কুলের শিক্ষকরাই এ লক্ষণগুলো অনুধাবন করে থাকেন।

HYPERACTIVE-KIDSলক্ষণ

সাধারণত অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভ ডিসঅর্ডার রোগের যে সকল লক্ষণ দেখা যাবে তা হলো:

  • শিশুটি হঠকারী কোন কিছু করছে কিনা।
  • অতিরিক্ত দুরন্তপনা করছে কিনা।
  • কোনো কিছু চিন্তা না করেই আবেগের বশে হঠাৎ অদ্ভূত কিছু করে ফেলছে কিনা।
  • কোনো বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে কিনা।
  • প্রায় সব সময়ই দৌড়াদৌড়ি করা বা ছোটাছুটি করা ইত্যাদি।

উপরের কারণগুলি দেখা গেলে এবং শিশুর বয়স ৭ বছরের কম হলে আর শিশুর এই সমস্যার স্থায়ীত্ব ৬ মাসের অধিক মনে হলে এডিএইচডি মনে করা যেতে পারে।

কারণ

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, শরীরের জিঙ্কের ঘাটতি এবং খাদ্যে মেশানো কৃত্রিম রঙের কারণেও এডিএইচডি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এই রোগের কারণ নিয়ে মতের কিছু পার্থক্য রয়েছে। এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নির্ণয় করা যায়নি, তবু কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। যেমন:

  • মস্তিস্কের প্রিফ্রন্টাল অংশে নিউরোট্রান্সমিটার নামক রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যার অস্বাভাবিকতার জন্য শিশুটি এমন আচরণ করতে পারে।
  • জেনেটিক বা বংশে কারোর এরকম সমস্যা থাকলে শিশুর মধ্যে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে কোনো শিশু বেড়ে উঠলে তার মধ্যে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • আপনজনদের নিকট থেকে পর্যাপ্ত স্নেহ না পেলে বা অবহেলার শিকার হলেও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় ধুমপানের কারণে বা মাদক সেবনের কারণেও জন্ম নেওয়া সন্তানের এ সমস্যা হতে পারে।

আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বে এ রোগের হার ১ দশমিক৭ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত। মেয়ে শিশুদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি ছেলে শিশুদের আক্রান্তের হার।

লক্ষণের ভিন্নতা

এ রোগে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে অমনোযোগীতা, হঠকারী কাজ করার প্রবণতা, অতিরিক্ত দুরন্তপনা ইত্যাদি লক্ষণের সবকটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একসঙ্গে থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সবকটি লক্ষণ আবার দেখা নাও যেতে পারে। যেমন হতে পারে শিশুটি অধিক অমনোযোগী আর হঠকারী ঠিকই কিন্তু দুরন্ত নয়। আবার অমনোযেগী দুরন্ত কিন্তু হঠকারী নয়। এনকি সে হঠকারী দুরন্ত কিন্তু লেখাপড়ায় একবারেই যে অমনোযোগী তা নয়। সাধারণত এ রোগের শিশুটি একমুর্হূতও চুপচাপ থাকতে পারে না।

সর্তকতা

স্বাভাবিকভাবেই শিশুরা চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাই চঞ্চলতাকে কখোনোই অসুখ মনে করবেন না। কারণ চঞ্চলতাই এই রোগ নয়। এই রোগের লক্ষণগুলি শিশুটির শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে হচ্ছে কি না সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কোনো আত্মীয় বা প্রতিবেশী অন্য কারের কথায় শিশুকে রোগী ভাবার কারণ নেই। কারণ একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই বলতে পারেন শিশুটি রোগী কিনা।

চিকিৎসা

শিশুর মধ্যে যদি এই রোগের লক্ষণ দেখতে পান তাহলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই রোগের ভালো চিকিৎসক আছে, ওষুধ আছে, আছে আচরণ পরিবর্তনকারী বিশেষ প্রশিক্ষণ। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাহায্য, বাবা মায়ের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, খাদ্য তালিকার সুনির্দিষ্টতা ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে এ রোগ সারানো সম্ভব। এছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ সমস্যাগুলো কমতে থাকে। আর যদি প্রাপ্ত বয়সেও এই সমস্যা বজায় থাকে তবে মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। তাই কোনো বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে।

Sharing is caring!

Leave a Comment