আ স্পেস ওডিসি: আধুনিক সাই-ফাইয়ের শুরু যেখানে
- মেহেরাবুল হক রাফি
“There is only one Kubrick. 2001 is a pure cinema.” — Christopher Nolan
উপমহাদেশের বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে জাপানিজ চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন, ‘সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা।’ সেই সত্যজিতই তাঁর ‘একেই বলে শুট্যিং’ বইতে লিখেছিলেন যে ছবি বানানোর কায়দা-কানুন শেখার জন্য স্ট্যানলি কুবরিকের একটি সিনেমা তিনি কুড়িবার হলে গিয়ে দেখেছিলেন। সিনেমাটির নাম ২০০১: আ স্পেস ওডিসি।
আ স্পেস ওডিসি যখন মুক্তি পায় ততদিনে ‘অপু ট্রিলজি’র মাধ্যমে সারাবিশ্বের বিদগ্ধ সিনেপ্রেমীদের কাছে সত্যজিত রায় এক অতিপরিচিত নাম। তবুও তিনি চলচ্চিত্রের টেকনিক্যাল এস্পেক্ট শেখার জন্য বারবার কুবরিকের কীর্তির দ্বারস্থ হয়েছে। তাহলে বুঝুন সিনেজগতে ২০০১: আ স্পেস ওডিসির মর্যাদা কতখানি!
কুবরিক ছবির গল্পটি ধার করেছেন সায়েন্স ফিকশনের গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে খ্যাত আর্থার সি. ক্লার্কের ‘সেন্টিনেল’ নামক এক ছোট গল্প থেকে। শ্যুটিংয়ের আগ দিয়ে চিত্রনাট্যের কাজটিও সম্পন্ন করেছেন দুজনে মিলে। পরবর্তীতে সিনেমার প্লটের উপর ভিত্তি করে একই নামের ঢাউস উপন্যাস লিখে ফেলেন আর্থার সি. ক্লার্ক। আর স্পেস ওডিসির ওপর লেখা গবেষণাপত্রের সংখ্যা হয়তো গুণেও শেষ করা যাবে না।
হলিউডের শ্রেষ্ঠ সম্পদের কথা উঠলেই সবার আগে আসবে সিটিজেন কেইন কিংবা দ্যা গডফাদারের নাম৷ ড্রামা জনরাকে সেলুলয়েড-দুনিয়ার সামনের সিটে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এই দুই সিনেমার ভূমিকা অগ্রগণীয়। অপরদিকে বর্তমানে বক্স-অফিসের ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্রগুলোর দিকে তাকালে সাই-ফাই মুভিগুলোর আধিপত্য টের পাওয়া যায়। টার্মিনেটর থেকে শুরু করে হালের এভাটার; সত্তর দশক-পরবর্তী প্রায় সকল সাই-ফাইয়ের শুরু আ স্পেস ওডিসি হাত ধরে। কি এমন ছিলো সেই আড়াই ঘন্টার ফিল্ম-রিলে যা মুক্তির পঞ্চাশ বছর পর আজো মানুষকে ভাবায় কিংবা আন্দোলিত করে তোলে রজার্ট ইবার্টের মতন সমালোচকদের মন?
প্রায় লক্ষ বছর আগের কথা। আদি মানবজাতির পূর্বপুরুষ হোমো ইরেক্টাসরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গহীন আফ্রিকার বিরানভূমির এখানে-সেখানে। যেখানে জীবন মানেই এক গুচ্ছ লতাগুল্মর জন্য আরেক গোত্রের সাথে মারামারি আর হানাহানি। এরই মাঝে এক ভোরবেলায় ইরেক্টাসদের অধিপতির চোখ যায় কালো রঙের চতুর্ভুজ সদৃশ মনোলিথের দিকে। মাত্র এক রাতের মধ্যে কোথা থেকে এলো এই বস্তু? অবাক বিস্ময়ে সেই মনোলিথের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে বাকি সকলে। এদিকে কয়েকজন সাহস করে সেটি ছোঁবার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে৷ সাথে সাথে বিদ্যুতস্পৃষ্টের মতন কিছু একটা যেনো বয়ে যায় তাদের শিরদাঁড়া বরাবর। এই অবর্ণনীয় অনুভূতি সেই ইরেক্টাসদের ভেতর নিয়ে আসে আশ্চর্য ধরনের পরিবর্তন। কি ছিলো সেই পরিবর্তন আর কে-ই বা মনোলিথটাকে সেখানে রেখে গেলো?
২০০১ সাল। চন্দ্রাভিযানের ছয় দশক পর সেখানে বসতি গেড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষকেরা। হটাত আমেরিকান বেজ ক্যাম্পের এক্সিপিডিশনে চাঁদের মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা অস্বাভাবিক বস্তুর উপস্থিতি টের পায় সকলে। আবারো সেই মনোলিথ! আবারো সেই পুরোনো অনুভূতি পুরোনো মানুষে!
এই মনোলিথকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে চলেছে ২০০১: আ স্পেস ওডিসির প্লট। তবে শুধু মনোলিথের মধ্যে মুভিটির মূল মন্ত্রকে আটকে রাখেননি কুবরিক। মানবসভ্যতার বিবর্তন, আগামীদিনের মহাকাশযাত্রা এবং যন্ত্রের সাথে মানুষের চিরায়ত দ্বন্দ; এ সবকিছুই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে আ স্পেস ওডিসিতে। মাত্র একটি চলচ্চিত্রে এতোগুলো সাব-প্লটের ঠাঁই দেওয়াটা সে আমলে সহজ বিষয় ছিলো না। পক্ষান্তরে ফিলোসফিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে আজও স্পেস ওডিসিকে নিয়ে হরদম কাটা-ছেঁড়া চলছে। গল্প বলার ধরণ এবং নিখুঁত সিনেম্যাটিক কারিকুরির ব্যবহার স্পেস ওডিসিকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়।
নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে বেড়ে ওঠা স্ট্যানলি কুবরিকের ফিল্ম ক্যাটালগের দিকে যদি কেউ তাকায় তাহলে যে কারোরই চোখ কপালে উঠে যেতে বাধ্য। পিরিয়ড ড্রামা, সাই-ফাই, ডার্ক কমেডি, হরর, রোমান্স, ওয়ার; এমন কোনো জনরা নেই যেখানে কুবরিক নিজের মুনশিয়ানার পরিচয় রাখেননি। কৈশোরকালে বিখ্যাত রাশিয়ান পরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’ এবং ‘অক্টোবর’ মুভি দুটি তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলো। এরপর নিজের ত্রয়োদশ জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে উপহার পাওয়া হ্যান্ড-ক্যামেরা নিয়ে কুবরিকের ফিল্ম-অবসেশনের শুরু। আর সেই অবসেশন বয়ে বেড়িয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
আ স্পেস ওডিসির কাজ ধরার আগে স্পার্টাকাস আর ড. স্ট্রেঞ্জলাভ দিয়ে দর্শক-সমালোচকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন কুবরিক। ফলে সে আমলের প্রায় ১০ মিলিয়ন বাজেটের স্পেস ওডিসি বানাতে গিয়ে ফান্ডিংয়ের ব্যাপারে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি তাঁকে। সিনেমাটিতে ব্যবহৃত কুবরিকের গ্রাউন্ড-ব্রেকিং ভিএফএক্স এবং ক্যামেরা-ওয়ার্ক সমসাময়িক পরিচালকদেরকেও অবাক করে দিয়েছিলো। কয়েক বছর আগে ইন্টারস্টেলার বানানোর সময় আ স্পেস ওডিসির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন বর্তমানকালের অন্যতম সেরা পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। মুভিটির বিভিন্ন অংশের বিজিএম তৈরিতে বাখ, মোজার্ট, বিথোভেন সহ অন্যান্য বিখ্যাত ক্লাসিক কম্পোজারের মিউজিকের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কুবরিক।
ছোটবেলায় দেখা আইজেনস্টাইনের সিনেমাগুলোর টেকনিক খুব দারুণভাবে স্পেস ওডিসিতে তুলে ধরেছেন এই আমেরিকান ফিল্মমেকার। কেইর ডুলেয়া এবং গ্যারি লকউডের মতন হেভিওয়েট অভিনেতারা থাকা সত্ত্বেও স্ক্রিণপ্লে’তে ডায়লগের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। আইজেনস্টাইনের সোভিয়েত মন্টাজ থিওরি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রচুর কাটশট এবং হিউম্যান এক্সপ্রেশন ব্যবহার করা হয়েছে মুভিটিতে। ডায়লগের অপ্রতুলতাকে পুষিয়ে দেয়া হয়েছে এরকম বিভিন্ন রূপক মন্টাজের মাধ্যমে। যার ফলে ক্যারেক্টারগুলোর অভিনয় আরো বেশি প্রাণবন্ত মনে হবে সকলের কাছে।
বিষয়বস্তুর জটিলতার কারণে প্রথমদিকে সাধারণ দর্শকদের বোধগম্যতার বাইরের জিনিস বলে মনে করা হচ্ছিলো আ স্পেস ওডিসিকে। কিন্তু পরবর্তীতে অনেক সমালোচকই এক বাক্যে স্বীকার করে নেন যে মুভিটি নিজ যুগের চাইতেও এগিয়ে ছিলো। জেমস ক্যামেরন, স্টিভেন স্পিলবার্গ, মার্টিন স্করসিজ থেকে শুরু করে হালের নোলান সহ অনেক বিখ্যাত পরিচালক বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজেদের ক্যারিয়ারে ২০০১: আ স্পেস ওডিসির প্রভাবের কথা বারংবার তুলে ধরেছেন। আজও সাই-ফাই জনরা নিয়ে কথা উঠলে যেকোনো আলোচনার শুরুতেই থাকে কুবরিকের এই অমর সৃষ্টির নাম।
আমরা কি, আমরা কোথা থেকে এসছি কিংবা কেন-ই বা আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে এসব প্রশ্নের উত্তরই খোঁজা হয়েছে পুরো মুভিজুড়ে। দৃষ্টিনন্দন শটের পাশাপাশি এরকম ফিলোসফিক্যাল থটের বাহার শতবর্ষ পরও যেকোনো মানুষকে ভাবাতে এবং ভাবতে সাহায্য করবে। তাই এখনো যারা আ স্পেস ওডিসি দেখেননি তাদেরকে কুবরিকের এই স্পেসশীপে স্বাগতম।
প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি