রাশোমন! নানা মুনির নানা মত

রাশোমন! নানা মুনির নানা মত

  • মোঃ তানভীর রহমান

বিচারক তার রায় কীভাবে দেয়? রায় দেওয়া কী খুব সহজ? একটা রায়ের পিছনে কতগুলো সত্য মিথ্যা গল্প লুকিয়ে থাকে তা শুধু হয়ত সেই বিচারকই বলতে পারবে। ঠিক তেমনই কুরাসাওয়ার তৈরী ‘রাশোমন’ সিনেমাটি আপনাকে একজন বিচারকের গদিতে বসাবে। তবে আপনি কী রায় দিতে পারবেন? চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক, ১৯৫০ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত এই বিখ্যাত সিনেমা ‘রাশোমন’ সম্পর্কে।

রাশোমন সিনেমাটি তৈরী করেছেন কিংবদন্তি জাপানিজ পরিচালক আকিরা কুরাসাওয়া। যে কিনা এই সিনেমার মাধ্যমেই নিজেকে এবং জাপানিজ ফিল্ম শিল্পকে সারা বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ১৯৫১ সালে সিনেমাটি ভেনিস ফিল্ম উৎসবে তখনকার সর্বোচ্চ পুরুষ্কার “দি গোল্ডেন লায়ন” পেয়েছে। তখনই মূলত মানুষ জানতে শুরু করে জাপানিজ ফিল্ম শিল্প সম্পর্কে।

এছাড়াও আকিরা কুরাসাওয়া বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের একজন অন্যতম প্রভাবশালী পরিচালক। আর তার একটি বিশেষত্ব হলো তিনি সিনেমা তৈরীর জন্য একটি নির্দিষ্ট দলকে ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ সিনেমাটোগ্রাফার, গান লেখকদের মতো একই লোক নিয়ে তিনি একাধিক সিনেমা তৈরী করেন এবং এই দলের নাম ছিল কুরাসাওয়া গুমি। তবে সবসময় যে এক তা নয় বলতে পারেন একটি স্থিতিশীল দল।

এই দল নিয়ে তৈরী বিশেষ কিছু সিনেমা হলো ইকিরু, সেভেন সামুরাই, থ্রোন অফ ব্ল্যাড, ইউজিম্ব, কাগামুসা । আরোও একটি মজার ব্যাপার হলো তার বেশীর ভাগ সিনেমাই পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে তাও আবার আমেরিকান ও ইউরোপের পরিচালকদের দ্বারা। এই রাশোমনও ১৪ বছর পর পুনরায় নির্মাণ করেন আমেরিকান পরিচালক মার্টিন রিট। পুনর্নিমিত সিনেমাটির নাম দ্যা আউটরেজ। এছাড়াও তিনি স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন সম্মানজনক একাডেমী এওয়ার্ড। সত্যজিৎ রায় এবং জাপানিজ পরিচালক মিয়াজাকির মত অনেক পরিচালকই তার দ্বারা অনুপ্রাণিত। 

সিনেমার অনন্য গল্প আর সিনেমাটোগ্রাফির অসাধারন কাজ দিয়েই রাশোমন জায়গা করে নিয়েছে চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসে। উনিশ দশকের সাদা কালো সিনেমায় প্রাকৃতিক ছায়ার এই অসাধারন দৃশ্যের সংমিশ্রণ এখনো মুগ্ধ করে দর্শকদের। গল্পটা এগারো শতকের সামন্ত্রতান্ত্রিক জাপানের সময়ের। “আমি বুঝছি না, আমি একটুও বুঝছি না”, রাশোমন গেটের নিছে বৃষ্টিতে ঠাই নেওয়া এক কাঠুরিয়া এভাবেই বলে যাচ্ছে এক সন্যাসীকে। আর আপনার আমার মধ্যে প্রশ্ন জাগাচ্ছে কী বুঝছে না?। কী বুঝছে না? প্রশ্ন নিয়েই শুরু হবে রাশোমনের গল্প। 

মূলত গল্পটি একটি ধর্ষনকে কেন্দ্র করে। মাথার উপরে রোদ, ঘন জংগল! কাধে কুড়াল নিয়ে হেটে যাচ্ছে কাঠুরিয়া গাছ কাটার উদ্দেশ্যে। হাটতে হাটতে তিনি দেখতে পান একটি মেয়ে মানুষের টুপি। কৌতূহল মনে টুপিটি হাতে নিয়েই আরোও সামনে এগিয়ে যান কাঠুরিয়া। সামনে গিয়েই দেখতে পান একটি লাশ। আর দৌড়ে গিয়ে তা পুলিশকে খবর দেন। ঘটনার তিন দিন পরই আদলতে সেই খুনিকে হাজির করা হয়। খুনি চরিত্রের নাম টাজোমারু। কিন্তু আমাদের প্রশ্নের উত্তর এখনো আসলো না। কাঠুরিয়া কী বুঝছে না? এটাই গল্পের মূল অংশ।

সেইদিন আদালতে জবানবন্দি দেন টাজোমারু সহ ধর্ষিত স্ত্রী এবং খুন হওয়া ব্যক্তি। কি অদ্ভুত তাই না? অদ্ভুত হলেও এটাই সত্য তিন জনের কাছ থেকেই নেওয়া হয় জবানবন্দি। আর সব থেকে মজার ব্যাপার হলো তিন জনই তাদের নিজেদেরকে খুনি বলে দাবি করে তাদের বর্নিত গল্পে। আর প্রত্যেকের গল্পের সাথেই মিল পাওয়া যায় ঘটনাস্থলের আলামতের সাথে। হ্যা, এবার আমিও বুঝছি না। তাহলে খুনি কে? এবার বিচার করার দায়িত্ব আপনার।

এই সিনেমার বিশেষত্ব শুধু গল্পতেই আটকে আছে তা কিন্তু নয়। একটি সাদা কালো সিনেমায় দৃশ্যের সংমিশ্রন এত অসাধারন হতে পারে তা শুধুমাত্র এর দর্শকই অনুভব করতে পারবে। চারপাশে জংগল, মাথার উপরে বড় বড় গাছ, সেই গাছের ফাক দিয়ে আসছে রোদের আলো আর তৈরী করছে একটি অসাধারন আলো ছায়ার পরিবেশ যার সাথে মিশ্র হচ্ছে ঘটনার সাথে তাল মিলিয়ে শব্দ। অর্থাৎ সিনেমার প্রতিটি মুহুর্তকে অনুভব করতে কিছু কম রাখেনি কুরাসাওয়া।

এছাড়াও এর একের পর এক দৃশ্যের যে পরিবর্তন, সিনেমার ভাষায় যাকে বলে জাম্প কাট যেটি কিনা এই সিনেমার বিশেষত্ব হওয়ার অন্য আরেকটি কারন। সহজ কথায় কুরাসাওয়ার প্রাকিতিক আলো ছায়া নিয়ে ক্যামেরার এই খেলা আজও আমাদের কথা বলায়।

শুধু কি তাই? সেই ১৯৫০ সাল থেকে সিনেমাটি আমাদেরকে ভাবিয়ে আসছে। যেই ভাবনা থেকে আমাদের সমাজে আজ একটি এর ব্যাখ্যাও রয়েছে। যার নাম “রাশোমন ইফেক্ট”। বলতে পারেন আমাদের সমাজে এই সিনেমাটি যে প্রভাব ফেলেছে তার একটি প্রতিফলন এটি। মূলত ১৯৬৬ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নুরি ইয়ালমান এই সিনেমা থেকে প্রভাবিত হয়ে “রাশোমন ইফেক্ট” ব্যাখ্যাটি করেন যা বর্তমানে বিচার ব্যবস্থা ও জার্নালিজমে একটি সুপরিচিত তত্ত্ব হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আমরা যেকোনো ঘটনার বিচার প্রত্যক্ষদর্শীর স্বাক্ষ্যকে গুরুত্ব দিয়ে করি।

যদি আদলতের ভাষায় বলি স্বাক্ষী হলো যেকোন মামলার প্রাণ, যার সত্যতার উপর নির্ভর করে সেই মামলার রায়। কিন্তু এই সত্যটা কী আসলে সত্য? কারন আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আবার আমাদের স্মৃতি সবসময় সঠিক তথ্য দেয় না। আমরা যা দেখি তা ভাবি আবার আমরা যা ভাবি তার উপর আমাদের দেখাও নির্ভর করে। তাহলে এবার প্রশ্ন আসছে সত্যের যাচাই কীভাবে করব? আর এটিই মুলত এই “রাশোমন ইফেক্ট” এর ব্যাখা দাঁড়ায়। অর্থাৎ কুরাসাওয়া শুধু আমাদের উপর বিচার করার দায়িত্ব ছুড়ে দেননি আমাদের চিন্তা ভাবনাতেও প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। 

শেষ করব! তবে কিছু কথা না বললেই নয়। রাশোমন থেকে আমাদের শেখার শেষ কখোনই হবে না। একটি সিনেমা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর চিন্তা ভাবনায় কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা হয়ত সিনেমাটি দেখলে নিজ থেকেই অনুমান করে নিতে পারবেন। সিনেমাটি ভালো লাগারও অনেকগুলো কারণও হয়তো বের হবে যা আমি বের করতে পারিনি। তবে ভালো অবশ্যই লাগবে এটা নিশ্চিত। সবাইকে রাশোমন গেটে আমন্ত্রণ রইলো।

প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Sharing is caring!

Leave a Comment