বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মার বুকে দৃশ্যমান দক্ষিণাঞ্চলের স্বপ্ন !
- মানিক তানভীর
বিশ্বমানের পদ্মা সেতু! বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মার বুকে দৃশ্যমান দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আগামী ২৫শে জুন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঐতিহাসিক এক স্থাপনা এই পদ্মা সেতু। স্বাধীনতার পর থেকেই যে সেতু ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন ,পদ্মায় নানা জল গড়ালেও একটা সময় পর্যন্ত বাস্তবে রূপ পায়নি সে স্বপ্নের সেতু। কিন্তু আজ স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে নানা বাধাবিঘ্নতা পার হয়ে এখন পদ্মা সেতুর ওপর চলবে গাড়ি, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নও যাবে বাড়ি।
স্বাধীনতার পর থেকেই পদ্মা সেতুর স্বপ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে বাঙালিকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরকারের আর্থিক অসঙ্গতি এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পক্ষে শুধুমাত্র একটি স্বপ্নের নাম ছিল পদ্মা সেতু। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সে স্বপ্ন দুমড়ে-মুচড়ে যায়। তারপর একটি দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন বিনির্মাণের। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শুরু হয় সেতু নিয়ে পরিকল্পনা। শুরুতে দাতাদের অর্থে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হলেও বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলার পর নানা নাটকীয়তার শেষে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাঙালি। ২০১৫ সালে নিজ অর্থায়নে নির্মাণ কাজ শুরু হয় পদ্মা সেতুর।বাঙালি, বাংলাদেশ ও বাংলা, এই শব্দ তিনটি সংগ্রামের, সাহসের এবং সব বাধা-বিপত্তি ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার। যা একাত্তরে প্রমাণ হয়েছে একবার এখন আবার পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাঙালি বুঝিয়ে দিয়েছে বাঙালি চাইলে যে কোন বাধা বা চ্যালেঞ্জ কে প্রতিহত করতে পারে। তাইতো বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ বাঙালির স্বপ্নের উপর যে আঘাত হানে তার উত্তম জবাব নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত আজকের পদ্মা সেতু। এজন্যই হয়তো বঙ্গবন্ধু বলেছিল, “আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে বারবার না।” পরাক্রমশালী বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে স্বল্পোন্নত একটি দেশের জন্য বিদেশি কোনো সাহায্য ছাড়াই ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা খরচ করে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপে ছিল। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার বছর দুয়েক পর ২০১৭ সালে কানাডার আদালত রায় দেয় বিশ্ব ব্যাংক প্রদত্ত পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।
এ তো গেল পদ্মা সেতু নির্মাণে আর্থিক বাধা। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে সেতুর নকশা এবং গঠনজনিত জটিলতা।
পদ্মা সেতু নির্মাণে গঠনজনিত জটিলতা
মাটির নিচে গঠনজনিত জটিলতায় পদ্মা সেতুর ৪১ টি পিলারের মধ্যে ১৪ টি পিলারের নকশা বদলাতে হয়েছে। মাটির নিচে একাংশের নরম মাটিতে পিলারের ঢালাই থাকছিল না। এই জটিলতা সমাধানে ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাউই (COWI) ইউকে লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির বিশেষজ্ঞরা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাদামাটির পরেই শক্ত মাটি না পাওয়ায় পদ্মা সেতুর ১৪ টি পিলারের মধ্যে পাইলের সংখ্যা একটি করে বাড়ানো হয়। অন্যদিকে এসব পিলারে খাঁজ-কাটা পাইল বসিয়ে বিশেষ ধরনের সিমেন্ট এর মিশ্রণে নরম মাটি শক্ত করা হয়। এই জটিলতার অবসানের পর ২০১৯ সালের শুরুতে আবার পুরোদমে নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, বিশ্বের দীর্ঘতম সড়ক সেতুর তালিকা ২৫ তম অবস্থানে রয়েছে পদ্মা সেতু। এছাড়াও পদ্মাসেতুর রয়েছে পাঁচটিরও অধিক বিশ্বরেকর্ড।
পদ্মা সেতুর বিশ্ব রেকর্ড
প্রমত্তা খরস্রোতা নদী পদ্মা! এক দশক আগেও যে নদীর ওপর সেতু নির্মাণ ছিল কেবল স্বপ্নই। প্রমত্তা খরস্রোতা নদীর ওপর পদ্মা সেতু নির্মাণকে ঘিরে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, পানি প্রবাহ বিবেচনায় বিশ্বে আমাজনের পরেই পদ্মা নদীর স্থান।প্রথমত পদ্মা নদীর গভীরতা তার ওপরের মাটির ১২০ থেকে ১২২ মিটার নিচে পাইল বসানো এ সেতুর একটি অন্যতম বিশ্ব রেকর্ড। পৃথিবীর অন্য কোন সেতুতে পাইল এত গভীরে প্রবেশ করানোর নজির নেই।
দ্বিতীয়ত পদ্মা সেতুর পিলার এবং স্প্যানের মাঝে যে বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে সেটি। এখানে ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বেয়ারিং ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীতে এর আগে কোন সেতুতে এত বড় বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি।
তৃতীয় রেকর্ড নদীশাসন। ১৪ কিলোমিটার (মাওয়া-প্রান্তে ১.৬ কি.মিঃ + জাজিরা-প্রান্তে ১২.৬ কি.মিঃ) এলাকা নদী শাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদীশাসনে খরচ হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি।
পরের রেকর্ডটি ব্রিজে ব্যবহৃত ক্রেন। পিলারের উপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি আনা হয়েছে চীন থেকে। প্রতিমাসে এর ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম এই ব্রিজটি বানাতেই এত দীর্ঘদিন ভাড়ায় থেকেছে এই ক্রেনটির বাজারদর ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
আরেকটি রেকর্ড পদ্মা সেতুর বিশ্বে প্রথম সেতু যেটি কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে নির্মিত। আর ইস্পাতের এই কাঠামোও শুধু পদ্মার এপার-ওপার কেই যুক্ত করল না, বরং জাতীয় জীবনের যুক্ত করল একটি ঐতিহাসিক অর্জন।
একেকটি সেতু কেবল এক একটি জনপদ কে যুক্ত করে না, সহজ করে জীবনকে; বাঁচিয়ে দেয় মহা মূল্যবান সময়। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংযুক্তির ব্যাপার তো থাকছেই। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় সাত কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের সেই স্বপ্ন কিংবা উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংযুক্তির দ্বারপ্রান্ত উন্মোচিত হবে চলতি বছরের ২৫ জুন।
পদ্মা সেতু শুভ উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণবঙ্গ মেতেছে আনন্দে। সেতু সাজাতে ব্যস্ত সেতু কর্তৃপক্ষ, হাতছানি দিচ্ছে অর্থনৈতিক মুক্তির। এ যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী আরেক বিজয়। এখন অপেক্ষা শুধু স্বপ্নটানে পদ্মাসেতু পাড়ি দেওয়ার।
প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা, মিডিয়া এবং যোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি