দিনটি ছিল মা বাবাকে জড়িয়ে ধরার
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
সেদিন সকালটা ছিল অন্যরকম। প্রায় ১১শ শিক্ষার্থী কয়েকটি বাসে চেপে ধানমন্ডি থেকে আশুলিয়া যাচ্ছেন, কিন্তু কারো মুখে কোনো রা নেই। বন্ধুরা মিলে গান গাইছেন না, হইচই করছেন না, উচ্চস্বরে গল্পও করছেন না। সবাই শান্ত, সৌম্য। ব্যাপার কি? ব্যাপার আর কিছুই নয়, এই শিক্ষার্থীরা তাদের মা বাবাকে এক অভিনব সম্মান জানাতে যাচ্ছেন আশুলিয়ায় অবস্থিত ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে। শ্রদ্ধায় অবনত তাই সবার মন।
বাস ক্যাম্পাসে পৌছার পর দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল সবুজ মাঠে প্রায় ১৭শ মানুষের জটলা। তাদের অধিকাংশেরই চোখে জল। সন্তানরা তাদের মা বাবার পা পানি দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছেন আর বাবা মা অঝোরে কাঁদছেন। খানিকবাদে আদরের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন তারা। তবে এ কান্না কষ্টের কান্না নয়, এ কান্না আনন্দের।
এ দৃশ্য গত শুক্রবারের (৩১ মার্চ)। সেদিন বাবা-মা হয়ে গিয়েছিলেন সন্তান, আর সন্তান হয়ে গিয়েছিলেন অভিভাবক। কারণ বাবা-মা এসেছে তার চিরচেনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এনে দেয়া, ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখানো—এক কথায় সার্বিক সহযোগিতায় পরম যত্নে বাবা-মাকে সহায়তা করে গেছেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারেন্টস ডে উপলক্ষে অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের এই মিলনমেলা বসেছিল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে। উপস্থিত ছিলেন প্রায় ১১ শ’ শিক্ষার্থী ও ৬০০ জন অভিভাবক। কথা হয় কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে। তারা বলেন, দিন দিন সন্তান এবং পিতা মাতাদের মাঝে দুরত্ব তৈরি করছে তথাকথিত আধুনিক সমাজ। সন্তানরা ভুলে যেতে বসেছে তাদের দায়িত্ব। এই দূরত্ব কমাতে এই ধরনের আয়োজন সত্যি প্রশংসনীয়।
তো কী ছিল সেদিনের প্যারেন্টস ডের আয়োজনে?
সকালের নাস্তা শেষে, সবুজ মাঠে সবাই একত্রিত হয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয় এবং শিক্ষার্থীরা শপথ করেন পিতা মাতার প্রতি নিষ্ঠাবান হবার। তারপর সন্তানরা পা ধুয়ে দেন পিতা মাতাদের, তখন অনেক বাবা-মা তাদের চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। তারপর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজুর সঞ্চালনায় অডিটোরিয়ামে শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠান। তিনি বলেন, ‘আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়। মানুষের মতো মানুষ হবার জন্য আর্ট অফ লিভিং দিক নির্দেশনার কাজ করে থাকে।’
‘আর্ট অফ লিভিং’ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যতিক্রমী এক সংযোজন । এই বিষয়ে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে শিক্ষার্থীর কথা-বার্তা, আচার আচরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি, চিন্তার প্রসার ঘটানো ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই কোর্সেরই অধীনে ‘প্যারেন্টস ডে’ অনুষ্ঠান পালন করা হয় চার মাস পর পর। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য এই কোর্স বাধ্যতামুলক। জানান সৈয়দ মিজানুর রহমান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান বলেন, ‘আপনাদের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। সেই লক্ষেই ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি কাজ করে যাচ্ছে। আপনার সন্তানের মেধাকে গুরত্ব দিয়ে সব দ্বার উম্মোচন করবার চেষ্টা করছে এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সর্বোচ্চ গুরত্ব প্রদান করে আসছে।’
এসময় মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম, রেজিস্ট্রার এ.কে.এম. ফজলুল হক, ট্রেজারার হামিদুল হক খান সহ অন্যান্য শিক্ষকরা।
এরপরেই সঞ্চালক সৈয়দ মিজানুর রহমান সন্তানকে জড়িয়ে ধরতে অনুরোধ করেন অভিবাবকদের। বাবা-মা তার আদরের সন্তানকে জড়িয়ে ধরতেই আবেগপ্রবণ দৃশ্যের জন্ম হয়। যার বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন না কিংবা অনুষ্ঠানের দায়িত্বরত অন্যান্য কর্মকর্তারাও চোখে জল ধরে রাখতে পারেননি।
তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত এক অভিভাবক আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বলেন, ‘ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মনে হয়েছিল যেন আমি আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছি।’
অপরদিকে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরাত নীলা বলেন, ‘আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরতে পারি নি কখনো। হয়ত সুযোগ হলেও লজ্জার কারণে তা সম্ভব হয় নি। আজ আমি মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আনন্দিত।’
এমন আবেগময় অনুভূতির প্রকাশ চলতে থাকে মঞ্চে। একসময় জুম্মার নামাজের সময় হয়ে যায়। তখন জুম্মার নামাজ ও দুপুরের খাবারের বিরতির সময় সুশৃঙ্খলভাবে খাবার সংগ্রহ করে পিতা-মাতার সঙ্গে খাবার গ্রহণ করেন শিক্ষার্থীরা। এ দৃশ্য দেখে অনেক অভিভাক মন্তব্য করেন, ‘এ যেন আর্ট অফ লিভিং এর ব্যবহারিক ক্লাস।’
বিরতি শেষে আবার মঞ্চে ফিরে আসেন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা। রংপুর থেকে আগত অভিভাবক মাহমুদুল হাসান সেলিম বলেন, ‘জঙ্গিবাদ দমনে এ ধরনের আয়োজন প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য জরুরী। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সুবৃহৎ সবুজ ক্যাম্পাস বেশ আকর্ষণীয় যা শিক্ষার্থীদের পদচারণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
শিক্ষার্থীরাও জানাতে থাকেন তাদের অনুভূতির কথা। এভাবে বিকেল ঘনিয়ে আসে। অনুষ্ঠান শেষে বাসে করে অভিভাবকদের গন্তব্যে পৌছে দেয়া হয়। আর এর মধ্যদিয়ে শেষ হয় আনন্দঘন এক প্যারেন্টস ডে।