ভেবেচিন্তে ফেসবুক চালাই
- আয়মান সাদিক
কিছুদিন আগে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাওয়ার লাইভ ভিডিওটি দেখছিলাম। চমৎকার সব ‘কমেন্ট’ সেখানে, জাকারবার্গ সাহেবকে অভিনন্দন জানানো থেকে শুরু করে কেউ কেউ ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার কথাও লিখেছেন। বাংলাদেশ থেকেও কিছু কমেন্ট দেখলাম। কয়েকটিতে চোখ আটকে গেল। একজন লিখেছেন, ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই।’ আরেকজনের সরস কমেন্ট, ‘এ কেমন বিচার?’ অনেকে আবার নিরলসভাবে ‘চিকন পিনের চার্জার’ চেয়েই যাচ্ছেন!
একটা কথা মাথায় এল এসব দেখে। এই যে মার্ক জাকারবার্গের ভিডিওতে এমন অপ্রয়োজনীয় আর অপ্রাসঙ্গিক কমেন্ট করেছেন অনেকেই, ব্যাপারটা কিন্তু নেহাতই রসিকতার পর্যায়ে থাকছে না।
আমাদের এ ধরনের মন্তব্য কিন্তু শুধু একজন মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করে না। এগুলো একটা দেশেরও প্রতিনিধিত্ব করে। এসব দেখে ভিনদেশিরা মনে করতেই পারেন, বাঙালিরা হচ্ছে বোকা, তারা জানেও না কোথায় কী মন্তব্য করতে হয়! একবার ভেবে দেখুন তো, ব্যাপারটা আমাদের দেশের জন্য কী সাংঘাতিক অপমানজনক!
ভেবে দেখলাম, মানুষকে দোষ দিয়েই বা কী লাভ। আমরা স্কুল–কলেজে যখন পড়েছি, তখন সেখানে প্রথম বছরেই একটা ‘ওরিয়েন্টেশন’ বা পরিচিতি পর্ব আয়োজন করা হতো। কী করতে হবে, কী করা যাবে না—এসব নিয়ে বিশদ জানানো হতো আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছুঁয়েও প্রথম বর্ষেই আমরা আরেকটা ওরিয়েন্টেশন পেয়েছি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর জন্য দিকনির্দেশনা ছিল। এই যে ভার্চ্যুয়াল জগতে আমরা বুঁদ হয়ে আছি, এই জগতের আদবকেতা কিন্তু আমাদের কেউ বলে দেয়নি। আর সে জন্যই এমন হাল হয়েছে অনেকেরই।
ফেসবুককে বলা যেতে পারে আমাদের ‘ডিজিটাল প্রোফাইল’। কখনো কখনো আপনার বাস্তব জীবনের চেনা মানুষগুলোর তুলনায় এই ভার্চ্যুয়াল জগতের চেনা মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই বাস্তব জীবনে ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে আমরা যতটা সচেতন, ফেসবুকে তার চেয়েও বেশি সচেতন হওয়া উচিত। ফেসবুককে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে যে ব্যাপারগুলো জানা সবচেয়ে জরুরি, সেগুলো নিয়েই একটু আলাপ করা যাক।
কী করা যায়
১. বাঁচুক প্রাণ
আমাদের আশপাশে এমন অনেক দাতব্য সংস্থা বা সংগঠন আছে, যারা প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহের জন্যে, মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য দিন–রাত খেটে চলেছে। এমনই একটি সংস্থার একজন আমাকে একটা ‘আইডিয়া’ দেন। খুব সহজ কিন্তু দারুণ কার্যকর আইডিয়া। আমাদের সবারই কিন্তু একটা সোশ্যাল আইডি কার্ড আছে। তার নাম ফেসবুক। এই ফেসবুকের প্রোফাইলে ছোট্ট একটা ‘বায়ো’ অংশ আছে। এইখানে আমরা নিজের পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি যদি নিজের রক্তের গ্রুপটাও দিয়ে দিই, তাহলে এই রক্তসন্ধানীদের জন্য অনেক সুবিধা হয়ে যায়, তাই না? এতে আরও দ্রুত রক্ত সংগ্রহ করা যাবে, হয়তো বাঁচবে আরও কিছু প্রাণ!
২. ফেসবুকেই হোক গ্রুপ স্টাডি!
বিশ্ববিদ্যালয়–পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় সব ব্যাচেরই নিজেদের জন্য একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে। সেখানে তারা ডিপার্টমেন্টের নানা খবর, নোটিশ নিয়ে পোস্ট করে। এই গ্রুপগুলোতে যদি ভালো ছাত্রদের মধ্যে কেউ উদ্যোগ নিয়ে পরীক্ষার আগে লাইভে যান, আর পড়া–বিষয়ক নানা সমস্যার সমাধান করে দেন, দারুণ হয় না ব্যাপারটা?
এতে করে যে বন্ধুটা পড়াশোনায় দুর্বল, তাঁর যেমন উপকার হবে, তেমনি ভালো ছাত্ররাও পড়াগুলো ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
৩. এক শেয়ারে হবে স্বপ্নপূরণ
এই আইডিয়াটা আমি পাই আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ, আরিফ আর হোসাইনের একটা স্ট্যাটাস থেকে। একটা স্কুল বানানো হচ্ছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে কাজটা আর এগোচ্ছিল না। আরিফ ভাইয়া করলেন কী, তিনি একটা স্ট্যাটাস দিলেন। খুব সহজ কাজ। স্কুলটার জন্য সবাইকে বললেন একটা করে শেয়ার কিনতে। ৩০০ টাকার একটা শেয়ার। কিছুদিনের মধ্যেই প্রচুর মানুষ এই শেয়ার কিনে স্কুলের জন্য টাকাটা জোগাড় করে ফেললেন! একবার ভাবুন, আপনার শেয়ারের কারণে কত শিশুর মুখে হাসি ফুটছে? মনটাই ভালো হয়ে যায় না ভাবলে? এভাবে একটা শেয়ার কেনার মাধ্যমে বিশাল একটা ভালো কাজের অংশ হয়ে যেতে পারেন আপনিও! ফেসবুককে কাজে লাগিয়ে ঘটতে পারে এমন অনেক সামাজিক বিপ্লব।
৪. ‘নেটওয়ার্কিং’-এর সুযোগ
ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে মামা–চাচার যুগ এখন আর নেই। ভালো অবস্থানে পৌঁছাতে হলে আপনার প্রয়োজন যোগ্যতা, আর অনেক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। ফেসবুক কিন্তু আপনাকে এই যোগাযোগের সুযোগটা করে দিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে ফেসবুকেই পরিচিত হয়েছি। এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধিদীপ্ত কথা দিয়েই আপনাকে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। বোকার মতো ‘অ্যাড মি অ্যাড মি…’ বলে লাভ হবে না।
কী করব না
১. ছদ্মনাম না থাকুক
স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্রে আমরা তো আমাদের পুরো নামটাই দিই, তাই না? ফেসবুককে যেহেতু আমাদের ‘ডিজিটাল প্রোফাইল’ বলা হচ্ছে, তাই ফেসবুকেও পুরো নামটা দেওয়া উচিত। সনদপত্রেও যদি আপনার নামের জায়গায় অদ্ভুত বালক, অ্যাঞ্জেল কণা কিংবা ড্রিম বয় রিফাত লেখা থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। নইলে নিজের নামে আইডি খুলতে দোষ কোথায়? আজকাল সিভি থেকে শুরু করে ভিনদেশে বৃত্তি কিংবা আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোর আবেদনপত্রেও অনেক সময় ফেসবুক প্রোফাইলের লিংক দিতে হয়। সনদপত্রের সঙ্গে নাম না মিললে তখন কিন্তু বিপাকে পড়তে হবে। তা ছাড়া ছদ্মনাম না ব্যবহার করার ব্যাপারে ফেসবুক আজকাল বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। শুধু ছদ্মনামের কারণেই আপনার পুরো ফেসবুক প্রোফাইলটা হঠাৎ একদিন গায়েব হয়ে যেতে পারে। তাই আইডিতে নাম লেখার ক্ষেত্রে ‘সৃজনশীলতা’ না দেখানোই ভালো।
২. প্রোফাইল পিকচারে আপনিই থাকুন
আপনি যদি আপনার প্রোফাইল পিকচারে সালমান খান বা একটা গোলাপ ফুলের ছবি দেন, তখন মানুষ স্বভাবতই ভাববে—আপনি তো সালমান খান নন; আর গোলাপ ফুল নিশ্চয়ই ফেসবুক আইডি খুলতে পারে না। অতএব, আপনার নিশ্চয়ই কোনো কুমতলব আছে! এ রকম অহেতুক সন্দেহ থেকে বাঁচতে নিজের প্রোফাইল পিকচার আর কভার ফটোতে নিজেরই একটা ছবি দিয়ে ফেলুন, যদি অন্য কোনো সমস্যা না থেকে থাকে।
৩. লেখার আগে ভাবুন
ফেসবুকের নিউজ ফিডকে বলা যায় ভার্চ্যুয়াল জগতের চৌরাস্তা। আপনি কি একটা চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যা ইচ্ছা তা–ই বলতে পারবেন? পারবেন না। সে জন্য ফেসবুকে কোনো পোস্ট করার আগে একটু ভেবে নেবেন, চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে এই কথা আপনি বলতে পারবেন কি না। এমন কোনো পোস্ট করবেন না, যেগুলোর জন্য আপনার তো বটেই, আপনার ফেসবুক বন্ধুদেরও মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়! ধরুন বাইরে অনেক রোদ। এখন আপনি যদি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, ‘বাইরে তীব্র রোদ, ফিলিং ঘাম ঘাম’, বাকিরা কিন্তু আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। আপনার কোনো কথাকেই আর গুরুত্বের সঙ্গে নেবে না।
৪. সুন্দর মন্তব্য, সুন্দর মন
আমরা ছোটবেলা থেকেই মা–বাবার কাছে এই শিক্ষাটা পেয়েছি, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হয়। বাস্তব জগতের এই ভদ্রতা কিন্তু ভার্চ্যুয়াল জগতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেউ একজন কিছু একটা পোস্ট করল, তাতে আক্রমণাত্মক মন্তব্য, গালাগালি করা কিংবা হুমকি দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়। আপনি হয়তো ভাবছেন এ তো সামান্য ফেসবুক, এখানে একটু ঝগড়াঝাঁটি করলে এমন কী আর হবে। কিন্তু এটা ফেসবুক বলেই আপনাকে খুব সহজে ‘ট্র্যাক’ করা যাবে, ধরে ফেলা যাবে। যে কথাটা আপনি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন না, মন্তব্যের ঘরেও সে কথাটা লিখবেন না। ‘কমেন্ট’ করার সময় একটু ভেবেচিন্তে করলেই দেখবেন আপনার ভার্চ্যুয়াল জীবনটা আরও সুন্দর হবে।
শেষ কথা
আমি জানি, যাঁরা এই লেখা পড়ছেন, তাঁরা সবাই ফেসবুকের এসব বিষয় নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তাই আশা করব, আশপাশের মানুষকেও ফেসবুকের এই ব্যবহারগুলো শেখাবেন! তাতে যেটা হবে, সারা বাংলাদেশ একসময় ঠিকভাবে ফেসবুক ব্যবহার করা শিখবে। আমাদের একটা সুন্দর ভার্চ্যুয়াল লাইফ হবে। হয়তো মার্ক জাকারবার্গের পরের লাইভ ভিডিওতে চিকন পিনের চার্জার বা নোয়াখালী বিভাগ নিয়ে নয়, দুর্দান্ত কোনো প্রশ্ন করবে বাঙালিরা, দারুণ কোনো মন্তব্য করে ভিনদেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দেবে!
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, টেন মিনিট স্কুল