রক্ত বিক্রি করে স্কুলের বেতন দিয়েছেন হাওয়ার্ড সুলজ

রক্ত বিক্রি করে স্কুলের বেতন দিয়েছেন হাওয়ার্ড সুলজ

হাওয়ার্ড সুলজের গল্প যেন রূপকথাকেও হার মানায়। এতটাই দরিদ্র ছিলেন যে নিজের শরীরের রক্ত বিক্রি করে স্কুলের বেতন দিয়েছেন। না খেয়ে থেকেছেন দিনের পর দিন। তবু হার মানেননি নিয়তির কাছে। নিজেই গড়েছেন নিজের ভাগ্য। যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন, সেই প্রতিষ্ঠানেরই মালিক হয়েছেন একসময়। হয়েছেন হত দরিদ্র অবস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ধনীদের একজন। তাঁর গল্প শোনাচ্ছেন মারুফ ইসলাম


দেখতে দেখতে তিরিশ বছর পার হয়ে গেল! হাওয়ার্ড সুলজের বিশ্বাসই হতে চায় না। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা! এর মধ্যে ক্যালেন্ডার থেকে হারিয়ে গেল তিরিশিটি বছর! ধুর ছাই! সময় বড্ড বেশি দৌড়ায়! হাওয়ার্ড সুলজ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিরিশ বছর আগের একদিন।

মনের মধ্যে একটিমাত্র সংকল্প নিয়ে আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ছোট্ট একটা কফির দোকান শুরু করেছিলেন সুলজ। আজ তাঁর সেই কফি শপ সারা পৃথবীব্যাপী এক জনপ্রিয় নাম-স্টারবাকস। এখন তিনি ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদের মালিক। কীভাবে এই খ্যাতির চূড়ায় উঠলেন তিনি? বলা বাহুল্য এ উত্থান মোটেও সহজ ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ব্রুকলিনে ১৯৫৩ সালে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম এই ব্যবসায়ীর। তারিখটা ছিল জুলাই মাসের ১৯। সাত বছর বয়স যখন সুলজারের তখন এক দুর্ঘটনায় পা হারান তাঁর বাবা। পেশায় তিনি ছিলেন একজন ট্রাক চালক। তখন এই ভদ্রলোকের কোনো স্বাস্থ্যবীমা করা ছিল না। ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিক হিসেবে মালিক পক্ষের কাছ থেকেও কোনো সহযোগীতা পাননি। ফলে এই দরিদ্র পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। এর মধ্য দিয়েই খেয়ে না খেয়ে বড় হতে থাকেন হাওয়ার্ড সুলজ।

১৯৮৭ সাল। এ বছরই স্টারবাকসকে ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন সুলজ।  সে বছর স্টারবাকস বাৎসরিক আয় করে ৯৩ মিলিয়ন ডলার। এখন পৃথিবীর ৬৫ দেশে স্টারবাকসের আউটলেট রয়েছে ২১ হাজার ! এখন তার বাৎসরিক বিক্রির পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর এসব আউটলেট থেকে বছরে আয় হয় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

এভাবে একদিন প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হন সুলজ। হাইস্কুল থেকে কলেজ। ইউনিফর্ম বদল হয়, কিন্তু ভাগ্য বদল হয় না। ততদিনে সুলজের পরিবার অতি দরিদ্র থেকে হত দরিদ্র পরিবারের কাতারে নেমে এসেছে। তরুণ সুলজ প্রাণপণে চেষ্টা করেন ভাগ্যটাকে বদল করার। এরকম এক সময়ে তাঁর ভাগ্যে মিলে যায় একটি অ্যাথলেটিক স্কলারশিপ। সুলজ ভালো ফুটবল খেলতন, সেই সুবাদেই নর্দান মিশিগান ইউনিভার্সিটির এই বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হন তিনি। এই বৃত্তি তাঁর জীবনে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল। এর আগে স্কুলের বেতন পরিশোধের জন্য সুলজকে নানা ধরনের কাজ করতে হয়েছে। কখনো কখনো শরীরের রক্তও বিক্রি করেছেন তিনি।

সময় থেমে থাকে না। সুলজের জীবনে চলে আসে ১৯৭৫ সাল। এ বছরই নর্দান মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর স্নাতক সম্পন্ন হয়। তিনি একটি চাকারির জন্য মাঠে নেমে পড়েন। শেষমেশ একটি চাকরি জুটিয়ে ফেলেন। জেরক্স কোম্পানিতে ‘বিপণন প্রশিক্ষক’ তাঁর পদ। কাজটা মোটেও উপভোগ করতে পারেননি সুলজ। বছর তিনেক পর ছেড়ে দিয়ে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। সেটি ছিল ঘর-গেরস্থালি ও রান্না-বান্না বিষয়ক যন্ত্রপাতি বিক্রির একটি প্রতিষ্ঠান। সুইডেনভিত্তিক সে প্রতিষ্ঠানের নামটা এখনো মনে আছে সুলজের-পারসটর্প।

স্টারবাকস কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাওয়ার্ড সুলজ। জন্ম ১৯ জুলাই, ১৯৫৩।
স্টারবাকস কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাওয়ার্ড সুলজ। জন্ম ১৯ জুলাই, ১৯৫৩।

নামটা মনে আছে, কারণ এই প্রতিষ্ঠানে তিনি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে জেনারেল ম্যানেজার ‌পর্যন্ত পদোন্নতি হয়েছিল তাঁর। এই প্রতিষ্ঠানে চাকরিকালীন সময়েই তিনি প্রথম স্টারবাকস সম্পর্কে জানেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে তখন মাত্র কয়েকটি কফিশপ। তারমধ্যে স্টারবাকসে অসংখ্য ক্রেতার ভিড়। ব্যাপরটি মনে ধরে যায় সুলজের।
সুলজ এরপর একদিন সময় বের করে সোজা চলে যান স্টারবাকসের মালিকদের কাছে। তখন স্টারবাকসের মালিক ছিলেন দুজন-জেরাল্ড ব্যাল্ডউইন এবং গর্ডন বোকার। এই দুই ব্যাক্তির ব্যবসার প্রতি ত্যাগ এবং সাহস দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে ফিরে আসেন।

এর বছর খানেক পরের কথা। সুলজের বয়স তখন ২৯। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় স্টারবাকসের বিপণন বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য। তখন স্টারবাকসের তিনটিমাত্র আউটলেট। তারা বাড়িতে বাড়িতে কফি সরবরাহ করে কূল পাচ্ছিলেন না।

মোটামুটি চলে যাচ্ছিল জীবন। এরপর সুলজের ক্যারিয়ারে বাঁক বদল ঘটে ১৯৮৫ সালে। সুলজ স্টারবাকস ছেড়ে দেন। একই সময়ে একজন ইতালীয় ভদ্রলোক তাঁর কফিশপ বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলেন। তার কাছ থেকে কফিশপটি কিনে নেন সুলজ। দোকানটির নাম ছিল জিওরনেল (ইতালীয় এ শব্দের বাংলা অর্থ প্রতিদিন) দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি এর আয় বাড়ান ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে। সুলজ আরও নতুন নতুন পরিকল্পনা আঁটেন। আরও দ্বিগুণ উৎসাহে পরিশ্রম শুরু করেন। পেরিয়ে যায় আরও দুই বছর।

১৯৮৭ সাল। এ বছরই স্টারবাকসকে ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন সুলজ। সেই থেকে সুলজের পরিচয় স্টারবাকস কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা! তখন স্টারবাকসের শাখা ছিল মাত্র ছযটি। এর পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৯২ সালে সারা আমেরিকায় স্টারবাকসের আউটলেট দাঁড়ায় ১৬৫টিতে। সে বছর স্টারবাকস বাৎসরিক আয় করে ৯৩ মিলিয়ন ডলার। এখন পৃথিবীর ৬৫ দেশে স্টারবাকসের আউটলেট রয়েছে ২১ হাজার!। এখন তার বাৎসরিক বিক্রির পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর এসব আউটলেট থেকে বছরে আয় হয় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

সুলজ তাঁর পেশাজীবনে সবসময়ই খুব গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের। তিনি তার কর্মীদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করেছেন। সুলজ বলেন, ‘ছোটবেলায় ঘটে যায় বাবার সেই দুর্ঘটনা এখনো দগদগে ক্ষত হয়ে আছে আমার জীবনে। তাই আমার কর্মীদের জন্য এই ব্যবস্থা।’

তথ্যঋণ : বিজনেস ইনসাইডার, উইকিপিডিয়া, ফোর্বস এবং স্টারবাকস নিউজরুম। favicon

Sharing is caring!

Leave a Comment