ভূমিপুত্র আতিউর আখ্যান

ভূমিপুত্র আতিউর আখ্যান

  • মো. সাইফ

২০১৫ সালে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন এশিয়ার সেরা গভর্নর। লন্ডনভিত্তিক বিখ্যাত অর্থনৈতিক পত্রিকা ইউরো মানির ইমার্জিং মার্কেটের পক্ষ থেকে তাঁকে এ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি আতিউর রহমান। তবে ২০১৫ সাল এই অবস্থানে আসতে তাঁকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক। অনলাইনের কল্যাণে তাঁর ছোটবেলার দূর্দশার জীবনের গল্প জানেন সবাই। প্রমিনেন্ট পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো ভূমিপুত্র থেকে আতিউর রহমান হয়ে উঠার গল্প।

ছোটবেলা

জামালপুর সদর থানার দিঘপাইত ইউনিয়নের পূর্বপাড় দিঘুলী গ্রামে ১৯৪৯ সালের ২৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আতিউর রহমান। অতি দরিদ্র ভূমিহীন এক কৃষক বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে আতিউর একজন। দারিদ্রতার সাথে কেটেছে ছোটবেলা। বিকেল হলে সবাই খেলতো, তিনি যেতেন বাজারে। সেখানে গাভীর দুধ বিক্রি করতেন। দুধ বিক্রির আয়ের আট টাকা দিয়ে পান-বিড়ির দোকান ও চালিয়েছেন তিনি।

শিক্ষাজীবন

গ্রামের এক সরকারী প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন। তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় একবার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল টাকার অভাবে। তবুও চালিয়ে গেছেন পড়ালেখা অনেক কষ্টে। অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তিনি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ক্যাডেট কলেজের সব ছাত্রদের মধ্যে প্রথম এবং ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় পঞ্চম হয়ে তিনি ক্যাডেট কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭০ সালেএইচএসসি দিলেন একই কলেজ থেকে। এখানেও কলেজের মধ্যে প্রথম এবং মেধা তালিকায় নবম স্থান অধিকার করলেন তিনি। এরপর ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং ১৯৭৬ সালে মাস্টার্স পাশ করার পর পান কমনওয়েলথ স্কলারশীপ। চলে যান লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে ১৯৭৯ সালে আবার মাস্টার্স করেন। পিএইচডি করেন ১৯৮৩ সালে।

কর্মজীবন

৯৭৫ সালে মাস্টার্স পড়াকালীন তিনি বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনে প্ল্যানিং অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এটি দিয়েই কর্মজীবনের শুরু তাঁর। পিএইচডি শেষ করার পর তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে (BIDS) । কর্মজীবনের ২৭ বছর পার করেন এই প্রতিষ্ঠানের সাথে থেকেই।

পরিবার

স্ত্রীর নাম ড. সাহানা রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিকস বিভাগের অধ্যাপক। আতিউর তিন কন্যা সন্তানের জনক। তারা হলেন অর্ণ কমলিকা, অর্চি মধুরিমা ও প্রকৃতি শ্যামলিমা।

index-2উল্লেখযোগ্য কাজ

১৯৯৪ সালে ইউএনডিপি কান্ট্রি প্রোগ্রাম-ভি এর মিড-টার্ম রিভিউয়ের সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭ সালে দারিদ্র দূরীকরণে বিভিন্ন নির্দেশনার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য মালদ্বীপে প্রেরিত জাতিসংঘের মিশনে নেতৃত্বদান করেন তিনি।১৯৮৯ সালে এগ্রিকালচার সেক্টর রিভিউয়ের অংশ হিসেবে ইউএনডিপি ঢাকার জন্য ‘ক্রেডিট ফর দির পুওর’ নামে গবেষণা করাসহ ইত্যাদি কাজগুলো উল্লেখযোগ্য৷ ‘উন্নয়ন সমুন্নয় (সমন্বয় নামেও পরিচিত) নামক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি যারা কাজ করে দেশের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে। বিআইডিএস থেকে ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা’ নামক জার্নাল বের করেছিলেন তিনি, যার বিষয়বস্তু ছিল ৮৫ শতাংশ গ্রামে থাকা মানুষদের উন্নয়ন।

বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর

আতিউর রহমান বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর হিসেবে নিযুক্ত হন ২০০৯ সালে। তার সময়ে বেশ কিছু সফলতা আসে ব্যাংকিং খাতে। ১০ টাকায় কৃষকদের ব্যাংক একাউন্ট খোলা, ছাত্রছাত্রীদের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা সহজ করা, বৈদেশিক রিজার্ভের অবস্থান সুদৃঢ় করা, মোবাইল ব্যাংকিং বিপ্লব ইত্যাদি।

গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্তির পূর্বে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন একসময়।২০০১ সালে, তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়া অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘উন্নয়ন গবেষণা’ বিষয়ে।

উল্লেখযোগ্য বই

অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই তার লেখা অসংখ্য বই রয়েছে। রাজনৈতিক অর্থনীতি (১ঌ৮৬), গরীবের বাজেট ভাবনা ও দারিদ্র বিমোচন (১ঌঌ৬), বাঁশের লড়াই বাঁচার লড়াই (১ঌঌ৭), অসহযোগের দিনগুলি: মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব (১ঌঌ৮), ভাষা আন্দোলন: পরিপ্রেক্ষিত ও বিচার (১ঌঌ০), রবীন্দ্র চিন্তায় দারিদ্র ও প্রগতি (২০০৪) ইত্যাদি বই উল্লেখযোগ্য।

সম্মাননা প্রাপ্তি

কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তিনি ২০১১ সালে ইন্দিরা গান্ধী স্বর্ণ স্মারক পুরষ্কারে ভূষিত হন। আর্থিক খাতের উন্নয়নে অবদান রাখায় শেলটেক পুরস্কার পান ২০১০-এ । তথ্যপ্রযুক্তিবান্ধব বাস্তবমুখী নীতি-উদ্যোগ গ্রহণের স্বীকৃতিস্বরূপ দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রযুক্তি মেলা ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১৫-তে তাঁকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় অসামান্য অবদান রাখায় ‘ধরিত্রী বাংলাদেশ জাতীয় সম্মাননা বঙ্গাব্দ ১৪২১’ পদক পেয়েছিলেন ড. আতিউর রহমান। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি’র সাহিত্য সম্মাননা-২০১৫ পুরস্কারও পান।

১৫ মার্চ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদ থেকে ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেছেন। তিনি যেভাবে স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছুটে চলেছেন, কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক এর গভর্নর হয়েছেন, সেটাকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিতে চান অসংখ্য তরুণ।favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment