এক টাকায় ভাত খাওয়ান কিশোর কুমার

এক টাকায় ভাত খাওয়ান কিশোর কুমার

  • লিডারশিপ ডেস্ক

‘ভাত আসছে রে, ভাত আসছে…’ বলতে বলতে ভরদুপুরে হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ে ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনের পদচারী সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটি। নাচতে থাকে সেতুর ওপর। উল্লসিত শিশুটির খুশির কারণ জানতে সামনে তাকাই। দেখি, কয়েক যুবক একটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে আসছেন। স্টেশনের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে এসে ভ্যানটি থামার আগেই স্টেশনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একঝাঁক শিশু ছুটতে লাগল সেটিকে লক্ষ্য করে। ঘিরে ধরল তরুণদের। শিশুদের সারি করে দাঁড় করিয়ে পরম মমতায় তরুণরা তাদের হাতে একটি করে বাটি তুলে দিলেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে নিলেন এক টাকা করে। বাটির ঢাকনা খুলে আনন্দের ঝিলিক তোলা চোখ-মুখ নিয়ে শিশুরা মেতে উঠল ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর সবজি খেতে।

কার চিন্তায় এক টাকায় দুই বেলা ভাত বিক্রির এ উদ্যোগের শুরু? কে সেই ব্যক্তি? তাকে জানার আগে শোনা যাক তার কথাগুলো, ‘আমার বাবা ছিলেন কৃষি অধিদপ্তরের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। ছয় ভাইবোনের মুখে অন্ন জোগাতে হিমশিম খেতেন তিনি। ক্ষুধার জ্বালা কী, তা আমি হাড়ে হাড়ে জানি। খাবারের জন্য কতদিন যে আশ্রমে ছুটেছি, বলতে পারব না। ভিড় ঠেলে ধাক্কাধাক্কি করে বাঁশের কঞ্চির মার আর খোঁচাখুঁচি উপেক্ষা করে আশ্রমের খিচুড়ি সংগ্রহ করতাম। তখন ভাবতাম, বড় হলে অভুক্তদের জন্য আমিও এমন ব্যবস্থা করব।’ তার সে চিন্তা বাস্তব হয়েছে পাঁচ মাস আগে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য এক টাকার বিনিময়ে দু’বেলা আহারের ব্যবস্থা করছেন তিনি। এক সময় যাকে খাবারের জন্য আশ্রমে ছুটতে হতো, তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত। ‘গুগল ক্লাউড ওয়্যার ৩৬০’-এর কমার্শিয়াল ডিরেক্টর তিনি। থাকেন পেরুতে। কিন্তু সেখানে গিয়েও ভুলে যাননি ছোটবেলার প্রতিজ্ঞা। পেরু প্রবাসী এ প্রকৌশলী গড়ে তুলেছেন এই সংগঠন। যেটিতে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ বিনা পারিশ্রমিকে এ কাজ করছেন।

ক্রেতা শিশুদের কথা : খাবার কিনতে এসেছিল সিদ্ধান্ত চন্দ্র বর্মণ। কথা হয় তার সঙ্গে। বয়স তার বড়জোর সাত-আট। কাঁধে কাঠের পেটি। নগরের মুরাদপুর তালতলা এলাকার বস্তিতে থাকে সে। মা অসুস্থ, বাবা অকর্মণ্য। পাঁচ সদস্যের পরিবারের বোঝা এ ক্ষুদ্র শিশুর কাঁধে। সকালে ষোলশহর স্টেশন এলাকায় জুতা সেলাই ও পালিশ করে সে। বিকেলে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের বিদ্যালয়ে পড়তে যায়। সিদ্ধান্ত বলে, ‘মা অসুস্থ, ঘরে সকালবেলা রান্না হয় না। পকেটে টাকা থাকলে বাইরে থেকে একটা কিছু কিনে খেয়ে নিই। না হলে দুপুরে এ ভাইয়াদের আনা এক টাকা দামের খাবার কিনে খাই। আগে হোটেলের বাসি খাবার খেতে হতো। এ খাবার অনেক ভালো, পরিমাণেও অনেক। এক টাকা দাম নিলেও পেট ভরে খেতে পারি।’ শুধু সিদ্ধান্ত নয়, তাসলিমা, সিয়ামের মতো ষোলশহর স্টেশন ও ফুটপাতের অনেক পথশিশুই এখান থেকে খাবার কিনে খেয়ে বেঁচে আছে।

শিক্ষা কার্যক্রমও শুরু করবেন স্বেচ্ছাসেবকরা : কথা বলি স্বেচ্ছাসেবক ইয়াছিন আরাফাতের সঙ্গে। দীর্ঘদিন বিদ্যানন্দের সঙ্গে যুক্ত তিনি। তিনি বলেন, ‘খাদ্য তো মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু সুষম বণ্টনের অভাবে কত খাবার নষ্ট হয়, অথচ কতজনকে আবার অভুক্ত থাকতে হয়। এ শিশুরা কিন্তু ভিক্ষুক নয়। আমরাও দাতা নই। আমরা তাদের প্রাপ্য খাবারটা টাকার বিনিময়েই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। যাতে তারা অভুক্ত না থাকে, যাতে তারা দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে।’ স্বেচ্ছাসেবক আজওয়াদ হোসেন বলেন, ‘শুধু খাবার বিতরণ করেই আমরা দায় সারি না। তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নৈতিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাও দেওয়া হয়। যাতে তারা অপরাধমুক্ত থাকে। তাদের আমরা শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসারও চেষ্টা করছি।’

প্রতিদিন সারাদেশের প্রায় ৩০০ পথশিশুর হাতে দু’বেলা খাবার তুলে দেন বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবকরা। প্রায় একশ’ নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন এ ফাউন্ডেশনে। রয়েছেন আরও কয়েকশ’ অনিয়মিত তরুণ স্বেচ্ছাসেবক। চট্টগ্রামে প্রতিদিন এ প্রক্রিয়ায় একশ’ শিশুর কাছে খাবার বিক্রি হয়। স্বেচ্ছাসেবকরা পালা করে নিজেরাই এর বাজার-সদাই করেন। খাবার তৈরি হয় ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন-সংলগ্ন একটি বাসার রান্নাঘরে। প্লাস্টিকের বক্সে করে স্বেচ্ছাসেবকরা তা পথশিশুদের হাতে তুলে দেন।

উদ্যোক্তার কথা : মুঠোফোনে কথা হয় এর উদ্যোক্তা কিশোর কুমার দাশের সঙ্গে। জানা গেল, তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। কিন্তু বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট খেজুরতলা এলাকায়। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় নিয়ে স্নাতক পাস করেন তিনি। এরপর যোগ দেন ইন্টারনেট প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান ‘ওলো বাংলাদেশে’। প্রতিষ্ঠানটির হয়ে ২০১২ সালে লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে যান তিনি। বর্তমানে তিনি গুগল ক্লাউড ওয়্যার ৩৬০-এর কমার্শিয়াল ডিরেক্টর। পেরুতে একটি হোটেলও রয়েছে তার।

কিশোর কুমার বলেন, ‘পেরুতে যখন আসি, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুবই হতাশ ছিলাম তখন। মনে হতো আত্মহত্যা করি। আবার ভাবতাম, এভাবে হেরে যাব আমি? কিছু একটা করতেই হবে আমাকে। বড় বোন আর দেশের একদল উদ্যমী তরুণকে নিয়ে ২০১৪ সালে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিদ্যানন্দের কার্যক্রম শুরু করি। দেখলাম, শিশুরা অভুক্ত থাকায় পড়াশোনায় তেমন মনোযোগই দিচ্ছে না। তাই এ বছরের ১৫ মে থেকে ‘এক টাকায় আহার প্রকল্প’ চালু করি। প্রথমে শুরু করেছিলাম নিজেই। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ প্রকল্পটিই চলছে দাতাদের অর্থায়নে। আমার কিছ বন্ধু আছেন, যারা নিয়মিত এ প্রকল্পে অর্থায়ন করেন। এ ছাড়া অনেকে স্বেচ্ছায় এ প্রকল্পে সহায়তা করেন। অনেকে আবার জন্মদিনসহ বিভিন্ন দিবস পালন না করে অনুষ্ঠান আয়োজনের টাকা শিশুদের খাবারের জন্য দিয়ে দেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না, এ খাবারকে কেউ দান বা ভিক্ষা মনে করুক। এ জন্য শিশুদের কাছ থেকে এক টাকা করে নেওয়া হয়। এখন কর্মসূচিটি সার্বজনীন হলেও ধীরে ধীরে এটিকে সীমাবদ্ধ করা হবে। যেসব পথশিশু স্কুলে যাবে তাদের কাছে এ খাবার বিক্রি করা হবে। এরপর উদ্বৃত্ত থাকলে তা অন্য শিশুদের কাছে বিক্রি করা হবে। এভাবে কম দামের খাবারের বিনিময়ে শিক্ষা বিস্তারের কার্যক্রম চলবে।’

শিশুদের দুই টাকায় দুই বেলার খাবার জোগান দিতে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের খরচ হয় মাসে প্রায় চার লাখ টাকা। তার মানে বছরে অর্ধকোটি টাকা। এর একটি বড় অংশ আসে সহৃদয় মানুষের সহায়তা থেকে। এভাবে ভর্তুকি দিয়ে প্রকল্পটি কতদিন চালু রাখা যাবে জানতে চাইলে কিশোর কুমার বলেন, ‘দেশের সব পথশিশুর অন্ন নিশ্চিত করা কারও একার পক্ষেই সম্ভব নয়। এ প্রকল্প আমৃত্যু চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাও নেই আমার। আমি একটি আইডিয়া সমাজের সবার সামনে তুলে ধরেছি। যারা চাইবেন, তারা এটিকে কাজে লাগাবেন। আরও ভালো আইডিয়ার জন্ম দেবেন। পথশিশুদের অন্ন-শিক্ষার সমস্যা একদিন নিশ্চয়ই দূর হবে।’

সূত্র: সমকালfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment